রোমারিও থেকে নেইমার, একই গল্প কি আবার ফিরছে?

By স্পোর্টস ডেস্ক
15 December 2025, 07:20 AM

খারাপ সময়ই কখনো কখনো ভালো লক্ষণ। ব্রাজিলে একটা কথা খুব চালু, জাতীয় দল যখন খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়, তখনই নাকি ভালো কিছু আসার ইঙ্গিত মেলে। কথাটা কেবল সান্ত্বনার জন্য নয়, বরং ইতিহাস থেকেই উঠে আসা এক ধরনের বিশ্বাস। স্থির পরিকল্পনা, সুসংগঠিত প্রস্তুতি, এসবের মূল্য অবশ্যই আছে। কিন্তু ব্রাজিল জানে, ফুটবলে সাফল্য অনেক সময়ই জন্ম নেয় বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা আর নাটক থেকে।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে। ১৯৭০ সালে টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে বরখাস্ত হয়েছিলেন কোচ জোয়াও সালদানিয়া। পুরো দেশ দুশ্চিন্তায় ছিল স্ট্রাইকার তোস্তাওয়ের ফিটনেস নিয়ে। তবু সেই দলই মেক্সিকোতে খেলেছিল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবল। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের টিকিট পেতে উরুগুয়ের বিপক্ষে শেষ দিকে দুই গোল না করলে ব্রাজিল হয়তো বাদই পড়ে যেত।

আর ২০০২ বিশ্বকাপের আগে যা ঘটেছিল, তা তো আজও রোমাঞ্চ জাগায় এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেই গল্প আবার নতুন করে ঘুরে ফিরে আসছে। তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের মিল এড়ানো কঠিন।

সেই চক্রে ব্রাজিল বদলেছিল চারজন কোচ; এই চক্রেও তারা আছে চতুর্থ কোচের অধীনে। ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল; ২০২৪ সালেও একই পরিণতি। ২০০২ বিশ্বকাপে তারা উঠেছিল প্রায় শেষ নিঃশ্বাসে; এবারও পরিস্থিতি খুব একটা স্বস্তির ছিল না।

বিশ্বাসীদের কাছে এতেই গল্প শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরও একটি উপাদান যোগ হয়েছে, একটি মানবিক গল্প, যা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে বরাবরই বড় হয়ে ওঠে।

২০০২ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার পর মিডিয়ার মনোযোগ ঘুরে গিয়েছিল রোমারিওর দিকে। ব্রাজিলিয়ান জনতার 'ব্যাড বয়' আইকন, শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে লড়াই করছিলেন তিনি। তাকে দলে নেওয়ার দাবিতে দীর্ঘ মিডিয়া ক্যাম্পেইন হয়েছিল; এমনকি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফের্নান্দো এনরিক কারদোসোও মন্তব্য করেছিলেন। কোচ লুইজ ফেলিপে স্কোলারি যখন রোমারিওকে দলে নিলেন না, রিও ডি জেনেইরোতে ক্ষুব্ধ জনতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। রোমারিও নিজে সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। দুই মাস পর? ব্রাজিল হারিয়েছিল জার্মানিকে, জিতেছিল পঞ্চম বিশ্বকাপ।

এবার আপনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন গল্পটা কোন দিকে যাচ্ছে। সময় এসেছে সেই চরিত্রটিকে মঞ্চে আনার। ২০২৬ বিশ্বকাপের 'ব্র্যাট প্রিন্স', যার ফর্ম, ফিটনেস, মানসিক অবস্থা, এমনকি চুলের কাটও আগামী ছয় মাসে এক বিশাল ধারাবাহিক গল্পে পরিণত হবে।

স্বাগতম নেইমার: দ্য রেফারেন্ডাম। আগুন-প্রতিরোধী জ্যাকেট আপনার সিটের নিচেই পাওয়া যাবে।

যারা গত এক-দুই বছরে নেইমার-জগৎ থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন, তাদের জন্য সংক্ষেপে বর্তমান অবস্থা। ২০২৩ সালের আগস্টে প্যারিস সাঁ জার্মাঁ ছেড়ে সৌদি ক্লাব আল হিলালে যোগ দেন নেইমার। দুই মাস পরই গুরুতর হাঁটুর চোট। এরপর আর সেই ক্লাবের হয়ে মাঠে নামা হয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে শৈশবের ক্লাব সান্তোসে সই করেন।

২০২৫ সালের ব্রাজিলিয়ান মৌসুমে তিনি খেলেছেন ২৯ ম্যাচ। গোল করেছেন ১১টি, করিয়েছেন আরও চারটি। ইনজুরির কারণে মিস করেছেন ১৭ ম্যাচ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে তার বয়স হবে ৩৪।

সংখ্যাগুলো প্রথম দেখায় খুব আশাব্যঞ্জক নয়। তুলনার জন্য বলা যায়, রোমারিও ৩৬ বছর বয়সে ২০০১ সালে ভাস্কোর হয়ে ৪০ গোল করেছিলেন, তার আগের মৌসুমে ৬৬। নেইমারের পরিসংখ্যান খুঁটিয়ে দেখলেও খুব সুবিধা হয় না। ১৫টি গোল অবদানের মধ্যে ছয়টিই এসেছে সাও পাওলো স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপের তুলনামূলক দুর্বল গ্রুপ ম্যাচে।

তবু একেবারে যে আলো নেই, তা নয়। ফেব্রুয়ারিতে আগুয়া সান্তার বিপক্ষে অসাধারণ স্কিলে পেনাল্টি আদায়, কয়েক সপ্তাহ পর সরাসরি কর্নার থেকে গোল, এমন ঝলক দেখা গেছে। ব্রাজিলেইরাওয়ের শেষ দিকে, মেনিস্কাস সমস্যায় ভুগেও, তিনি প্রায় একাই সান্তোসকে রেলিগেশন লড়াই থেকে টেনে তুলেছিলেন।

কিন্তু ভালো মুহূর্তের চেয়ে ম্লান সময়ই ছিল বেশি। ঘন ঘন হ্যামস্ট্রিং সমস্যায় তার ছন্দ ভেঙেছে, দলেরও। পুরোপুরি ফিট থাকলেও তাকে অনেক সময় এমন মনে হয়েছে, যেন এক বছরের বেশি সময় মাঠের বাইরে থাকার ছাপ শরীরে রয়ে গেছে। হাঁটুর বড় চোটের পর এটা স্বাভাবিক, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বয়সজনিত ধীরগতি, স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেই বাঁকানো পায়ের জাদু।

আর নেইমার মানেই তো শুধু ফুটবল নয়, নাটকও বটে। মিরাসলের বিপক্ষে ৩-০ হারের ম্যাচে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের উসকানি দেওয়া, নভেম্বরে ফ্ল্যামেঙ্গোর কাছে ৩-২ হারের সময় সতীর্থ ও রেফারির সঙ্গে ঝগড়া করে বদলি হওয়ার পর টানেলে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়া, এসবই এসেছে সঙ্গে।

সেই ম্যাচের পর সাবেক ব্রাজিল কোচ ভান্দারলেই লুক্সেমবার্গো বলেছিলেন, 'সে বড় নাম, কিন্তু সঠিক উদাহরণ তৈরি করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবল দলগত খেলা। সত্যিকারের নেতা সঠিক মানসিকতা দিয়ে দলকে এগিয়ে নেয়।'

আরেক সাবেক কোচ এমেরসন লেয়াও তো আরও কঠোর। সিএনএন ব্রাজিলকে তিনি বলেন, 'সে কারও জন্যই উদাহরণ নয়। আমি নেইমারকে আমাদের সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখি না। আমরা ওকে ছাড়িয়ে গেছি।'

লেয়াও বলছিলেন জাতীয় দলকে নিয়ে। অনেক ব্রাজিলিয়ানই হয়তো একমত। কিন্তু আরও আকর্ষণীয় হলো, কত মানুষ একমত নন।

চোট আর বয়স দেখে মনে হতে পারে, ব্রাজিল নিশ্চিতভাবেই 'পোস্ট-নেইমার' যুগে ঢুকে গেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে জাতীয় দলে তার শেষ ম্যাচ। এরপর ২৮ জন খেলোয়াড় অভিষেক করেছেন। প্রজন্ম বদল ঘটছে।

কিন্তু রোমারিওর মতোই নেইমার এমন একজন, যাকে ব্রাজিল ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। কার্লো আনচেলোত্তি জাতীয় দলের কোচ হওয়ার পর প্রায় প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনেই তাকে নেইমার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়েছে। এই সপ্তাহে মেনিস্কাসের অস্ত্রোপচারের খবরে আবারও শুরু হয়েছে ২০২৬ বিশ্বকাপের দৌড় নিয়ে অসংখ্য আলোচনা।

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বড় নামগুলোও এখনও তাকে গভীর শ্রদ্ধায় দেখেন। রোমারিও সেপ্টেম্বরে স্পোর্টটিভিকে বলেছিলেন, 'নেইমার থাকলেই কেবল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ আছে।'

রোনালদোও একই সুরে কথা বলেছেন, 'জাতীয় দলে সে ম্যাচ নির্ধারণ করে দিতে পারে। আমাদের কাছে ওর মতো আর কেউ নেই।'

আনচেলোত্তির সামনে আক্রমণভাগে বিকল্পের অভাব নেই ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রাফিনিয়া, রদ্রিগো, এস্তেভাও, মাতেউস কুনিয়া, জোয়াও পেদ্রো, লুইজ হেনরিক, রিচার্লিসন, গাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি সবারই স্বপ্ন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া। তবু রোনালদোর কথায় যুক্তি আছে: নেইমার আলাদা। গত ১৫ বছরে ব্রাজিলের হয়ে এত নিয়মিতভাবে আর কেউ ম্যাচের ভাগ্য বদলায়নি। তার সৃজনশীলতা, তারকা উপস্থিতি সব মিলিয়ে সে অনন্য। যদি সে আবার নিজের সেরা রূপে ফিরতে পারে, তাকে বাদ দেওয়া সহজ হবে না।

কিন্তু এই 'যদি'-র ভেতরেই সব প্রশ্ন। সে কি চোটমুক্ত থাকতে পারবে? টানা ম্যাচ খেলতে পারবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ২০২৬ সালে তার সর্বোচ্চ মানটা কোথায় দাঁড়াবে? ২০২৩ সালেই তো সেই ছাদ একটু নেমে গিয়েছিল।

আনচেলোত্তি বরাবরই স্পষ্ট। তিনি শুধু ফিট খেলোয়াড়ই নেবেন। নেইমারের প্রশংসাও করেছেন বহুবার। তবে মাসের শুরুতে বিশ্বকাপ ড্রয়ের পর আবার একই প্রশ্ন শুনে তার কণ্ঠে সামান্য বিরক্তির ছাপ ছিল।

'নেইমার যদি যোগ্য হয়, যদি ফিট থাকে এবং অন্যদের চেয়ে ভালো খেলতে পারে, তবে সে বিশ্বকাপে খেলবে,' বলেছেন আনচেলোত্তি। 'আমি কারও কাছে ঋণী নই।'

দরজা খোলা আছে। কিন্তু খুলতে হবে নেইমারকেই।

আর তাতেই ফিরে আসা যায় রোমারিওর গল্পে এবং একমাত্র নিশ্চিত সত্যে: আগামী ছয় মাস দেখার মতো হবে। যেদিকেই গল্প গড়াক না কেন।