বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী নিকটজনের হাতে খুন
এই প্রতিবেদন লেখা শুরু ও শেষ করতে প্রায় এক ঘণ্টা—এ সময়ের মধ্যে বিশ্বে অন্তত ৬ জন নারী তার ঘনিষ্ঠজন বা পরিবারের কোনো সদস্যের হাতে খুন হয়েছেন।
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে নারীহত্যার এমন ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) এবং নারী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনওমেন) প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে জাতিসংঘ।
এতে বলা হয়, শুধু ২০২৪ সালে ৮৩ হাজার নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০ হাজার নারী তার সঙ্গী, স্বামী, প্রেমিক বা পরিবারের সদস্য—যেমন: চাচা, মামা বা ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ এবং প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী বা কন্যাশিশু পারিবারিক বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে থাকা ব্যক্তির হাতে খুন হচ্ছেন।
নারী সহিংসতা বন্ধে নেই অগ্রগতি
জাতিসংঘ বলছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও নারীদের বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে কোনো বাস্তব উন্নতি দেখা যাচ্ছে না, বরং পরিস্থিতি এখনো অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
হত্যার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ঘরই নারী ও মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান বলে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।
এ বিষয়ে ইউএনওডিসির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক জন ব্র্যান্ডোলিনো বলেন, 'ঘর এখনো অনেক নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান। ফেমিসাইড রোধে আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ ও বিচারিক ব্যবস্থার প্রয়োজন।'
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীহত্যার হার
১১৭টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের কোনো অঞ্চলই নারী নির্যাতনজনিত হত্যাকাণ্ড থেকে মুক্ত নয়।
২০২৪ সালের আঞ্চলিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আফ্রিকায় নারী হত্যার হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১ লাখ নারীর ৩ জনকে হত্যা করা হয়। ওই বছর আফ্রিকায় প্রায় ২২ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া, ২০২৪ সালে এশিয়া অঞ্চলে ১৭ হাজার ৪০০, আমেরিকায় ৭ হাজার ৭০০, ইউরোপে ২ হাজার ১০০ এবং ওশেনিয়ায় ৩০০ নারীকে হত্যা করে তার পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠজনরা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী মোট হত্যাকাণ্ডের ২০ শতাংশ নারী হলেও পরিবারের মধ্যে সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছে এমন নারীর সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি।
২০২৪ সালে ঘনিষ্ঠজনের হাতে নিহত হয়েছেন এমন নারী ৬০ শতাংশ হলেও পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ।
সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে প্রযুক্তি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিছু ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা আরও বাড়িয়েছে এবং নতুন ধরনের সহিংসতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
অনিচ্ছাকৃত ছবি শেয়ারিং, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, ডিপফেক ভিডিও তৈরি ও সাইবার স্টকিংয়ের মাধ্যমে ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া—এসব ঘটনা বাস্তব জীবনে শারীরিক সহিংসতায় রূপ নিতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা হত্যাকাণ্ডে গড়াতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের নারী নীতি বিভাগের পরিচালক সারাহ হেন্ড্রিক্স বলেন, 'ফেমিসাইড বা নারীহত্যা কখনোই একদিনে ঘটে না। এটি অনলাইন ও অফলাইনে নিয়ন্ত্রণ, ভয় দেখানো, হয়রানি—এসবের ধারাবাহিক ফল।'
হেন্ড্রিক্স বলেন, 'আমাদের এমন আইন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যা অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই নারীদের জীবনে সহিংসতা কীভাবে প্রকাশ পায় তার স্বীকৃতি দেয়।'
একইসঙ্গে অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার ওপর জোর দেন তিনি।
প্রয়োজন জরুরি সমন্বিত উদ্যোগ
নারী সহিংসতা বন্ধে ছয়টি ক্ষেত্রে তৎপর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। সেগুলো হলো—শক্তিশালী আইন ও নীতিমালা, বেঁচে যাওয়া নারীদের জন্য সহায়ক সেবা, অপরাধ তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মান উন্নয়ন এবং সহিংসতা প্রতিরোধে সামগ্রিক সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া।
