আমন ধানের দাম কমে যাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় কৃষকরা
সারা দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ আমন ধান কাটা শেষ। কিন্তু এরই মধ্যে বাজারে ফসলটির দাম কমে যাওয়ায় কৃষকরা হতাশ। গত বছরের তুলনায় এবার মণপ্রতি ধানের দাম কমেছে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
দ্য ডেইলি স্টারের ১৩টিরও বেশি জেলার সংবাদদাতাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে ধানের দাম আরও কমেছে। এর ফলে অনেক কৃষকই উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না।
চাষি ও চাল আমদানিকারকরা মনে করছেন, রেকর্ড পরিমাণ ও অসময়ে চাল আমদানিই দাম কমার প্রধান কারণ।
শাকিউল ইসলাম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কৃষক। তিনি ৯ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন। জমির লিজসহ তার মোট খরচ হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। তিনি ১৭০ মণ ধান পেয়েছেন।
১৫ দিন আগে শাকিউল ৫০ মণ ধান ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছিলেন। বর্তমানে ওই একই ধানের দাম ১ হাজার ১৮০ টাকা। তিনি জানান, এই দামে ধান বিক্রি করলে তার লোকসান হবে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক আব্দুর রউফ বলেন, 'স্বর্ণা জাতের আমন ধানের দাম গত বছর ছিল ১ হাজার ৩৮০ টাকা মণ, এখন তা কমে হয়েছে ১ হাজার ১৮০ টাকা।'
তার অভিযোগ, কৃষকরা ধান বিক্রি করলে দাম কমে যায়। কিন্তু মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হাতে গেলেই দাম আবার বাড়ে।
দিনাজপুরের কৃষক সরওয়ার আলম জানান, সারের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই এই দামে ধান বিক্রি করলে বিঘা প্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা লোকসান হবে।
বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মতে, গত বছরের তুলনায় এক কেজি আমন ধান উৎপাদনে খরচ ১ টাকা বেড়ে এখন ৩১ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ, মণপ্রতি খরচ ১ হাজার ২৪০ টাকা।
জয়পুরহাটের কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, 'এ বছর আলুতে ব্যাপক লোকসান হয়েছে। এখন ধান থেকেও লাভ হচ্ছে না। আমরা কীভাবে বাঁচব?'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫৬ লাখ ১২ হাজার জমিতে আমন চাষ হয়েছিল। এবার ৫৯ লাখ ২৩ হাজার জমিতে চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩ লাখ হেক্টর বেশি।
৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৬ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। এতে ১ কোটি ৫ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থবছরে ৫৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল।
খুলনার কৃষক বিভাস মণ্ডল জানান, এ বছর ফলন ভালো হলেও দাম খুব কম।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক মিখাইল হাসদা বলেন, 'গত বছর শুরুতে ধানের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ। কিন্তু এ বছর ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে এখন ১ হাজার ১৫০ টাকায় নেমেছে। এতে আমাদের লোকসান হবে।'
এ বিষয়ে একইরকম উদ্বেগ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। ধানের দাম কমার কারণ হিসেবে তারা বাড়তি আমদানিকে দায়ী করছেন।
পাবনার দাশুরিয়ার ধান ব্যবসায়ী মো. নূরুল আমিন বলেন, গত সপ্তাহে ভালো মানের শুকনো ধান মণপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৮০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
সরকার প্রতি কেজি আমন ধান ৩৪ টাকা দরে ৫০ হাজার টন কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এতে মণপ্রতি দাম আসে ১ হাজার ৩৬০ টাকা।
বগুড়ার ব্যবসায়ী বারেক উদ্দিন ও গাইবান্ধার মিজানুর রহমান দাম কমার জন্য আমদানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেন। মিজানুর রহমান মনে করেন, আমদানি বাড়ায় সরবরাহ বেড়েছে। তাই আগামী এক মাস দাম কম থাকতে পারে, তারপর আবার বাড়বে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোনো চাল আমদানি হয়নি। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৪ লাখ ৩৬ হাজার টনেরও বেশি চাল আমদানি হয়েছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত ২ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয় ২২২ জন আমদানিকারককে ১ লাখ টন সেদ্ধ চাল আমদানির অনুমতি দেয়। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
শীর্ষস্থানীয় চালকল মালিক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মজুমদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার জানান, আট মাস আগে ৫৭ টাকা কেজি দরে ৯০ কোটি টাকার চাল আমদানি করেছিলেন। এখন ৪৭ টাকা কেজি দরেও সে চাল পুরোপুরি বিক্রি হয়নি।
তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কম থাকার কারণে এখনো আমদানি করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। এর কারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়া।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী চালের গড় দাম ৩১ শতাংশ কমেছে এবং ২০২৬ সালেও ১ শতাংশ কমার পূর্বাভাস রয়েছে।
চিত্ত মজুমদার বলেন, যদি সরকার চাল আমদানির সময়সীমা আরও বাড়ায়, তাহলে কৃষকদের এবং যারা আগে বেশি দামে চাল কিনে রেখেছিলেন, তাদের ক্ষতি হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে স্থানীয় বাজারে প্রচুর পরিমাণে ধান মজুত আছে। কিন্তু এই ধান কেনার জন্য ক্রেতা খুবই কম।
প্রতি বছর চিত্ত মজুমদারের প্রতিষ্ঠান দেশীয় বাজার থেকে ৬ থেকে ৭ লাখ বস্তা ধান কেনে। কিন্তু এই আমন মৌসুমে তার প্রতিষ্ঠান এক কেজি ধানও কেনেনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, কৃষকের দাম এবং ভোক্তার জন্য বাজারের স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রাখা জরুরি। তিনি সতর্ক করেন, যদি চাল আমদানি বন্ধ করি তাহলে হয়তো দেখা যাবে চালের দাম আগামী কাল থেকে ৮০ টাকা কেজি হবে।
তিনি আরও বলেন, কৃষকরা চাইলে মানসম্মত ধান সরাসরি সরকারি গুদামে বিক্রি করতে পারেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টন, যা গত বছরের ১১ লাখ ২ হাজার টনের চেয়ে বেশি।
খুচরা বাজারে এখন মোটা চাল ৫৪-৬০ টাকা, মাঝারি চাল ৫৮-৬৮ টাকা এবং চিকন চাল ৭২-৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে চিকন চালের দাম ৬.০৮ শতাংশ, মাঝারি চালের ১.৬১ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৮.৫৭ শতাংশ বেড়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান সরকারের আমন ধান ব্যবস্থাপনাকে মারাত্মক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন।
তিনি বলেন, দাম যখন বেশি ছিল তখন আমদানি দেরিতে করা হয়েছে। আর এখন ফসল কাটার সময় আমদানি শুরু করে বাজারকে অস্থির করা হয়েছে, যা কৃত্রিমভাবে ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের সীমিত ধান কেনার পরিকল্পনা কৃষকদের কোনো সুরক্ষা দিতে পারছে না। উল্টো ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কিনতে পারছেন।
তার মতে, অবিলম্বে আমদানি বন্ধ করা উচিত এবং অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ বাড়ানো উচিত। ধান কাটার মৌসুমে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে নীতিমালাতেও পরিবর্তন আনা দরকার।
(এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের পাবনা, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নরসিংদী, জামালপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ এবং খুলনা সংবাদদাতা)