মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে হত্যা ও গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার নিয়ে যা জানাল পুলিশ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের বাসায় টাকা চুরি নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজকে ছুরিকাঘাত করে গৃহকর্মী আয়েশা।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এসএম নজরুল ইসলাম এ কথা জানান।
গতকাল ঝালকাঠি থেকে অভিযুক্ত গৃহকর্মী আয়েশাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে এ সংবাদ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে ডিএমপি।
গত সোমবার সকালে লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
তার আগেরদিন ওই গৃহকর্মী বাসা থেকে ২ হাজার টাকা চুরি করে এবং এ নিয়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয় বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার এসএম নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, 'যদি ২ হাজার টাকার জন্য বাগবিতণ্ডা না হতো, গৃহকর্মী ইচ্ছা করলে পরদিন আর কাজে নাও আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছুরি-চাকু নিয়ে পরদিন ওই বাসায় যায়। তার অর্থ হলো, তিনি অপরাধের ইনটেনশন নিয়ে বাসায় ঢুকেছেন।'
পুলিশ এখনো টাকা চুরির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, 'আয়েশা আগেও এক বাসায় চুরি করেছিল। গত ২৫ জুলাই আরেক বাসা থেকে ৮ হাজার টাকা চুরি করে ধরা পড়েছিলেন। সেটা নিয়ে জিডিও হয়েছে। এটা একটা ক্লু হিসেবে কাজ করেছে। তিনি তার নিজের বোনের বাসা থেকেও চুরি করেছেন।'
'তিনি চুরি করার ইনটেনশন নিয়ে মোহাম্মদপুরের এই বাসায় এসেছিল। এর দুটো কারণ হতে পারে। আগে এসে সিকিউরিটি গার্ডকে বলেছিলেন যে তার মা-বাবা বেঁচে নেই। তার শরীর পুড়ে গেছে। তবে এটা একটা অ্যালিবাই হতে পারে,' বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ জানায়, 'আয়েশার শরীরের পোড়া দাগ নিয়ে আমরা দুই ধরনের তথ্য পেয়েছি। একবার বলেছেন যে তিনি মায়ের সঙ্গে কোনো এক সময় রাগারাগি করে নিজের গায়ে আগুন দিয়েছিলেন। অন্য এক জায়গা থেকে জেনেছি যে, কোনো এক বাসায় কাজ করার সময় চুলা থেকে আগুন লেগে তার গলা পুড়ে গেছে। আমরা দুটো তথ্যই ভেরিফাই করছি।'
সংবাদ ব্রিফিংয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, 'চার দিন তিনি ওই বাসায় যাতায়াত করেছেন একদম পুরো মুখ ঢেকে। হত্যার পর সেফ এক্সিটের জন্য তিনি কাপড় বদলেছেন। পরে নিহত মেয়েটার কাপড় পরে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়।'
তিনি বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদে গৃহকর্মী আয়েশা বলেছেন যে, চুরির ঘটনার বিষয়টি পুলিশে জানানোর জন্য স্কুলে থাকা গৃহকর্তাকে ফোন করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আয়েশা প্রথম আক্রমণ করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি আমাদের এটাই বলেছেন। মায়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় লায়লার মেয়ে যখন ইন্টারকমে সিকিউরিটি গার্ডকে জানাতে যায়, তখন আয়েশা মাকে রেখে মেয়েকে ছুরিকাঘাত করে। আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে এরকম তথ্যটি এসেছে।'
'আমরা তদন্তের খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, তাদের পেছনে কোনো সিন্ডিকেট আছে কি না, এটা নিয়ে আমরা আরও তদন্ত করব,' বলেন তিনি।
পুলিশ জানায়, ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আয়েশা গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজকে সুইচ গিয়ার দিয়ে এলোপাতারি ছুরিকাঘাত করে। এ সময় লায়লার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে নাফিসা এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। ছুরিকাঘাতের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা-মেয়ে দুজনই নিহত হন।
অতিরিক্ত কমিশনার জানান, আয়েশা ছুরি ধুয়ে বালতিতে রেখে ল্যাপটপ, একটি মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাগে নিয়ে পালিয়ে যান। পরে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান এবং সাভারের দিকে রওনা হন। চুরি করা ফোন ও রক্তমাখা পোশাক তিনি সিংগাইর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেন।
তিনি বলেন, 'যেহেতু আয়েশা বোরকা পরতেন, সিসিটিভি ফুটেজে তার মুখ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছেও তার সঠিক ঠিকানা ছিল না, যার ফলে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।'
'কিন্তু আয়েশার পোড়া দাগ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া গেছে। আমরা এরপর গত এক বছরে মোহাম্মদপুর থানায় গৃহকর্মীর চুরির ঘটনা বিশ্লেষণ করে জুলাই ২০২৫ সালে হুমায়ুন রোডে ৮ হাজার টাকা ও একটি সোনার আংটি চুরির ঘটনার সঙ্গে মিল পাই। ওই মামলার সন্দেহভাজনের নামও আয়েশা, যার ঘাড়ে পোড়া দাগ ছিল বলে জানতে পারি,' বলেন তিনি।
পুলিশ পরে আয়েশার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে সাভারের হেমায়েতপুরে যান। আয়েশা ও তার স্বামী সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। অভিযানে বাড়িটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ ঝালকাঠির নলছিটি থানার চরকায়া গ্রামে স্বামী রাব্বির পৈতৃক বাড়ি থেকে আয়েশাকে গ্রেপ্তার করে।
