‘যেকোনো শিল্পের স্রষ্টা সমস্যার মুখোমুখি হন’

খান মো. রবিউল আলম
খান মো. রবিউল আলম
4 November 2025, 13:10 PM
UPDATED 4 November 2025, 19:46 PM
যদি কেউ নিজের পরিপক্কতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন, তার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ঋত্বিক ঘটকের একটি সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়, যা ১৯৬২ সালের অক্টোবরে 'চলচ্চিত্রের ভলিউম ০৩'-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঋত্বিক ঘটক যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা 'ফেস টু ফেস অ্যা কনভারসেশনস উইথ দ্য মাস্টার' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এতে মোট ১৮টি সাক্ষাৎকার রয়েছে। এটি সংকলন করেছেন শিবাদিত্য দাশগুপ্ত আর সম্পাদনা করেছেন সন্দিপন ভট্টাচার্য। 

জন্মশতবর্ষে তার স্মরণে সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে অনূদিত।

চলচ্চিত্র: আপনার মতে চিত্রনাট্য এবং নাটকের মধ্যে প্রকৃতি এবং শৈলীর দিক থেকে কী কী পার্থক্য রয়েছে?

ঋত্বিক ঘটক: প্রধানত দুটি মাধ্যমের ভিন্নতার কারণে পার্থক্য অনেক। মঞ্চ কখনো নাটকীয়তা লুকানোর চেষ্টা করা হয় না; তা করলে নাটক ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রে শুরু থেকেই দর্শকদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়।

এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে চলচ্চিত্রে মঞ্চপনা এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। এটি নাট্যবিরোধী, ন্যারেটিভ-বিরোধী আধুনিক চলচ্চিত্র চর্চার জন্ম দিয়েছে। এই পার্থক্যের কারণে চলচ্চিত্র নির্মাতারা কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা চিন্তা করতে পারেন। চলচ্চিত্র শুরু থেকে দর্শকদের মনে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি এনে দেয়। অসুবিধাটি হলো নাটকীয় চলচ্চিত্র পরিশুদ্ধ নয় বা বলা যায় স্টেজ ম্যানেজড।

প্রকৃতি এবং শৈলী পরস্পর সম্পর্কিত। বিষয়ের বিভিন্ন দিকে যাওয়ার চেয়ে, আমি বরং মৌলিক সত্যটি সংক্ষেপে তুলে ধরছি—

এটি সত্য যে ব্রেশট নাটককে মহাকাব্যে রূপান্তরিত করেছেন। চীন, জাপান ও ভারতের প্রাণবন্ত শিল্পের ধরনগুলো বিস্ময়করভাবে পশ্চিমা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে গেছে। এই কারণেই ব্রেশট চলচ্চিত্র মাধ্যমের অনেক সুবিধাও নিয়েছেন। অন্যদিকে, পল ভালেরির চলচ্চিত্রের মূল ঘাটতি হলো তা কেবল দর্শকদের উপরের বাস্তবতায় নিয়ে যায়। কিন্তু ভালেরি যা দেখাতে চায়, তার চেয়েও আরও গভীর সত্যি আছে। ব্রেশট এটি সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারতেন। চলচ্চিত্র গভীর দার্শনিক সত্যকে কতদূর পর্যন্ত প্রকাশ করতে সক্ষম, তা প্রশ্নাতীত নয়। একটা পর্যায়ের পর চলচ্চিত্রে একটি বিষয় হালকা বিষয়ে পরিণত হওয়ার প্রবণতা থাকে। কালজয়ী সংগীত, চিত্রকলা বা নাটকে এটি ঘটে না।

এখানে ভুল বোঝার আশঙ্কা আছে জানি। বিষয়টির পুরো ব্যাখ্যা করতে গেলে বেশ সময় লাগবে। আমি এটি ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছি না যে, পিরানদেল্লোর কাজের পর রাশোমন নতুন কিছু আনেননি। অনেকের সঙ্গে বসে উপভোগ্য কোনো শিল্প সম্পর্কে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলাটা বেশ কঠিন। নাটকও বহু দর্শক উপভোগ করেন। কিন্তু নাট্যকার জানেন মঞ্চের বাইরেও তার লেখার একটা মূল্য আছে। নাট্যকার কাজের সময় খেয়ালে রাখেন। একজন চিত্রনাট্যকারের এমন ভাবনার কোনো সুযোগ নেই।

আমি আরেকটি বিষয় ভাবতে বলব। নাটক সম্পূর্ণ জাতীয় বিষয়। দেশীয় ভাষা এর মাধ্যম। চিত্রনাট্য অনেকসময় ভাষাগত সংকটে পড়ে। দেশজ ভাষা এবং বিষয় হলেও নাটককে অনেক সময় জাতীয় সীমানার বাইরে যেতে হয়। কেউ গভীর কোনো সত্য প্রকাশ করতে চাইলে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পটভূমিতেই তা তাকে বলতে হবে। কিন্তু সংশয়ের বিষয় হলো যারা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিসর সম্পর্কে জানেন না তারা বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবে। এই আশঙ্কা প্রায়শই চিত্রনাট্যকারদের সহজ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এ কারণে তারা কিছুটা সস্তা চিত্রনাট্য তৈরি করেন। ভারতীয় সাহিত্যে প্রজাপতি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সত্যজিতের অপরাজিতার 'প্রজাপতি'র কথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় এসেছে, তা কি বিদেশি দর্শকদের প্রভাবিত করতে পারে? তার রচনায়, এই প্রতীক একটি মহান শক্তি এবং সন্ন্যাস জীবনের প্রতীক।

চলচ্চিত্র: সার্থক সাহিত্যকর্মের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় নির্মাতাকে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়?

ঋত্বিক ঘটক: 'সার্থক' শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সাহিত্যকর্মকে চলচ্চিত্র নির্মাতার সম্মতি অর্জন করতে হবে। মৌলিক সাহিত্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতাকে চলচ্চিত্রের উপযোগী কল্পনার জগতে যেতে গভীরভাবে অনুরণিত করেন। আলোচনার স্বার্থে বলি, অন্তত যা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য উপযুক্ত তা হলো অর্থপূর্ণ সাহিত্যকর্ম।

সেই অর্থে দুই ধরনের অর্থপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হতে পারে। প্রথমত, চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন স্পিরিটের দিক থেকে সাহিত্যকর্মের দার্শনিকতার ভেতর ঢুকে পড়েন। দ্বিতীয়ত, যখন অসত্য বর্ণনা আংশিক সমালোচনার জন্ম দেয়। আইজেনস্টাইনের প্রস্তাবিত অ্যান আমেরিকান ট্র্যাজেডির চিত্রনাট্য দ্বিতীয় প্রকারের একটি উদাহরণ। আইজেনস্টাইন ড্রেইজারের আলোচনার বিষয়ের প্রধান অংশের সঙ্গে একমত ছিলেন। তাই তিনি মূল সত্যের (গল্পের) তাৎপর্য এবং অর্থ পরিবর্তন করেছেন। এটি সমস্ত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। তবুও, তিনি এটি প্রদর্শন করেননি। বরং তিনি ড্রেইজারের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপিত তথ্যগুলো আবার অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার সীমাবদ্ধতাগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। এর পরে তিনি তার কাজ চালিয়ে যান।

এই কারণেই ড্রেইজার তাকে উৎসাহিত করেছিলেন। এটি একটি সাধারণ সমস্যা। এক্ষেত্রে, সাহিত্যের পুরো বিষয় গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। 'পথের পাঁচালী' একটি ভালো উদাহরণ। চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন সাহিত্যের সম্পূর্ণকে গ্রহণ করার উদ্যোগ নেন, তখন সমস্যা দেখা দেয়; যেমন: যখন গোর্কির মা তৈরি করেছিলেন পুদভকিন। দুই শিল্পী সত্যিকার অর্থে স্পিরিটের দিক থেকে একমনা ছিলেন। তবুও পরিচালক সেখানে উপস্থাপনার সময় পরিবর্তন আনেন।

উদাহরণস্বরূপ: পাভেলের কারাগার থেকে বাড়ি ফেরার দৃশ্য। বাড়ি ফেরার পথে বিস্তৃত সবুজ মাঠে তার মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। এটি ছিল মূল উপন্যাস থেকে স্পষ্ট বিচ্যুতি। তবুও, গোর্কি এই দৃশ্যটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন।

এখানে বিষয় হলো কোনো উপন্যাসের সারমর্মের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন শিল্প বানাতে হবে। সাহিত্যের ধরনকে চলচ্চিত্রের ভাষায় শৈল্পিকভাবে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা থেকে এর সৃষ্টি। তবে অনেকসময় এ আশঙ্কা  থাকে যে, এ ধরনের সৃষ্টি থেকে অদ্ভুত ও বিষ্ময়কর কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। তবুও, এ ঝুঁকিটা নিতে হবে।

আসলে সবকিছুই নির্ভর করে চলচ্চিত্র পরিচালকের শিক্ষা ও সৃজনশীল প্রতিভার ওপর। যদি তিনি জানেন যে তিনি কী প্রকাশ করতে চান এবং কীভাবে তা প্রকাশ করতে চান, তবে যেকোনো সাহিত্যকর্ম পূর্ণসত্য প্রকাশ করতে পারে। তাকে জানতে হবে কী গ্রহণ এবং কী বর্জন করবেন। চলচ্চিত্রটি দর্শকদের মনে করিয়ে দেবে যে, পরিচালক সাহিত্যকর্মকে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাকে সাহিত্যকর্মের কোনো একটি দিকই কেবল চমকিত করেনি।

চলচ্চিত্র: সাহিত্যকর্ম থেকে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের সমস্যা ও সুবিধাগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?

ঋত্বিক ঘটক: শিল্পকলায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি সাহসের সঙ্গে এবং স্পষ্টভাবে প্রকাশ প্রয়োজন। যখন সাহিত্য বা শিল্পের অন্য কোনো শাখায় বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না, তখন মৌলিক কিছু সৃষ্টির তাগিদ দেখা দেয়। এটি বহুল স্বীকৃত, যা নিয়ে আলোচনার কিছু আছে বলে মনে করি না।

সাহিত্যকর্ম থেকে স্বাধীন চলচ্চিত্র বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনি কি অন্যের গল্পের ওপর ভিত্তি করে নিজের চলচ্চিত্র তৈরি করতে চান না? যদি আপনি এটাই বোঝাতে চান, তাহলে শিল্পীকে নিজস্ব শৈলীতে নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। যেকোনো শিল্পের মূল স্রষ্টা এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এটি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সাধারণ কোনো সমস্যা না।

এক্ষেত্রে আমি স্বাধীন। আমি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। কারণ আমি মূল স্রষ্টা। এর অনেক অসুবিধা আছে। যেমন: মূল বিষয়টি কিম্ভুতকিমাকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একজন হয়তো অন্যজনের ধারণা ফুটিয়ে তুলতে নাও পারেন। এমনকি পুরো ধারণাটি হয়তো অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে।

যদি কেউ নিজের পরিপক্কতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন, তার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি স্বাধীনভাবে চলতে গিয়ে কাউকে একটি পাতিলে লাথি মারতে হয়, তবে সেটিও হবে পরিপক্ক কাজ। হাঁটার সময় অন্যের আঙুল ধরে হাঁটার চেয়ে নিজের মতো হাঁটাই বেশি অর্থপূর্ণ।