‘এটাই দুনিয়ার একমাত্র জায়গা যেখানে মানুষ এখনো আমাকে চায়’

মাহমুদ নেওয়াজ জয়
মাহমুদ নেওয়াজ জয়
4 November 2025, 11:54 AM
UPDATED 4 November 2025, 18:16 PM

'দ্য মেকার অব ফিল্মমেকারস' বইয়ে রাধা চাড্ডা তার বাবা জগত মুরারির প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। সেই মানুষ যিনি একেবারে শূন্য থেকে দাঁড় করিয়েছিলেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এফটিআইআই)। আর সেই গল্পের ভেতরেই ভেসে ওঠে এক অসামান্য শিল্পীর নাম—ঋত্বিক ঘটক।

ঘটক যখন এফটিআইআইয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে আসেন, তখন জগত মুরারি তার ভেতর এক দুর্লভ গুণ আবিষ্কার করেন। ঘটক শুধু চলচ্চিত্রকার নন, তিনি এমন এক শিক্ষক যিনি কথা বললেই শিক্ষার্থীদের মনে আগুন ধরিয়ে দিতে পারেন। তার ভেতরে ছিল সেই বাড়তি দীপ্তি, যা কেবল প্রতিভাবান শিক্ষক ও শিল্পীর মধ্যেই থাকে। আর এ সময়েই ঘটক ছিলেন সৃষ্টিশীলতার এক বিরল শিখরে—মাত্র তিন বছরে তিনটি অনন্য ছবি বানিয়েছিলেন—মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২ সালে নির্মিত হলেও মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে)।

কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হলো—তার জীবদ্দশায় এই ছবিগুলো, মেঘে ঢাকা তারা বাদে, দর্শক ও সমালোচকের কাছে তেমন সাড়া পায়নি। বাংলার দর্শক তাকে প্রায় এড়িয়ে গেল, সমালোচকরা দিলেন নিস্তেজ প্রতিক্রিয়া। সেই ব্যর্থতার ভার তাকে একরকম থামিয়ে দিলো। নতুন ছবি বানানোর পথ বন্ধ হয়ে গেল। অর্থকষ্ট গ্রাস করল। ঠিক তখনই এফটিআইআইয়ের ডাক এলো তার কাছে।

১৯৬৩ সালের শেষ দিকে জগত তাকে পুনেতে আমন্ত্রণ জানান। ডিপ্লোমা ফিল্ম রঁদেভু নির্মাণ তদারকি ছিল তার প্রথম কাজ। ঘটক সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। কারণ এখানে তিনি শুধু কাজের সুযোগই পাচ্ছিলেন না, বরং একটি এমন জায়গা যেখানে তাকে সম্মান করা হচ্ছে। জগতের চোখে ঘটক ছিলেন সেই দুর্লভ শিক্ষক—যার মধ্যে রয়েছে দারুণ প্রতিভা এবং সময় দেওয়ার অবারিত সুযোগ।

জগত ঘটকের ছবির ভক্ত ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, ইনস্টিটিউটের জন্য ঘটক বারবার আসা-যাওয়া করলে দারুণ উপকার হবে। বিশেষত পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, যেখানে নতুন কিছু করার সুযোগ সবসময়ই থাকে। জগত নিজেই চাইতেন তার সহকর্মী অধ্যাপকরা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। তার কাছে গবেষণা ও পরীক্ষাই ছিল একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি।

তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শিক্ষকরা যদি নিয়মিত ছবি না বানান তবে তাদের দক্ষতা ভোঁতা হয়ে যাবে। আর এসব ছবি শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করত। যেমন: মিশেল উইনের ওয়ান ডে। শুধু তাই নয়, এই ছবিগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতলে ইনস্টিটিউটের নামও ছড়িয়ে পড়ত। পরের বছরগুলোতে দেখা গেল এডিটিং অধ্যাপক আর কে রামচন্দ্রনের 'রেইন্স' মেলবোর্ন উৎসবে পুরস্কার পেল, সিনেমাটোগ্রাফি অধ্যাপক সি ভি গোপালের 'রেইন অ্যান্ড শাইন' অংশ নিল এডিনবরো উৎসবে।

ritwik_ghatak.jpg
ছবি: সংগৃহীত

এই পরিবেশ ঘটকের কাছে ছিল ভীষণ আকর্ষণীয়। এখানে প্রযোজকদের সংকীর্ণ মানসিকতা নেই। এখানে প্রতিটি অধ্যাপককে দেওয়া হচ্ছে সুযোগ—মূল্যবান সেলুলয়েড, শুটিং সুবিধা—সবই যাতে তারা পরীক্ষা করতে পারেন।

তাই ১৯৬৩ সালে জগত প্রথমবার ঘটককে ভাইস প্রিন্সিপাল ও পরিচালনা বিভাগের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু সমস্যা হলো বেতন। ঘটকের চাহিদা ছিল অনেক বেশি। অবশেষে পদটি দেওয়া হলো মারাঠি চলচ্চিত্রকার রাম গাবলেকে, যিনি যথেষ্ট ভালো বেতন পেলেও ঘটকের চাইতে কম। তবে ঘটক অতিথি শিক্ষক হিসেবে আসা চালিয়ে গেলেন।

গাবলের চাকরি দীর্ঘ হলো না। সক্রিয় চলচ্চিত্রে ফেরার লোভ সামলাতে না পেরে ১৯৬৪ সালের শেষেই তিনি চলে গেলেন। কয়েক মাস পদটি শূন্য রইল। অবশেষে ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘটককে পূর্ণকালীন নিয়োগ দিতে পারলেন জগত।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটকের মেয়াদ ছিল আরও ছোট—মাত্র চার মাস, ১৯৬৫ সালের ৫ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এবার তাকে থামিয়ে দিলো চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ নয়, বরং মদ্যপানের আসক্তি। যদিও সময়টা অল্প ছিল, তবুও তার প্রভাব ইনস্টিটিউটের ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে রইল।

জগত আগেই জানতেন ঘটকের বড় সমস্যা মদ। হয়তো বারবার ছবির ব্যর্থতাই তাকে গভীর আসক্তিতে ঠেলে দিয়েছিল। তবুও কেন জগত তাকে ভাইস প্রিন্সিপাল, অর্থাৎ ডানহাত হিসেবে নিয়োগ দিলেন?

কারণ জগত ছিলেন এক অনন্য আশাবাদী মানুষ। তিনি সবার ভেতরে সম্ভাবনা দেখতে চাইতেন। হয়তো মনে করেছিলেন ঘটকের নেশা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে যাতে কাজ ব্যাহত না হয়। তিনি জানতেন একে পুরোপুরি সারানো সম্ভব নয়, তাই তাকে অতিথিশালায় রাখলেন—অন্তত নিরাপদ থাকার জন্য। কিন্তু বড় কারণ ছিল, তিনি ঘটককে হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। তার চোখে ঘটক ছিলেন এক 'চলচ্চিত্রের গুরু'। 'মেঘে ঢাকা তারা' আর 'সুবর্ণরেখা' বানানো মানুষটি ছাত্রদের কিছু না কিছু দিয়ে যাবেনই।

ঘটকের চলচ্চিত্র ছিল আবেগময় মানবিক নাটক, যেখানে সাধারণ মানুষ ইতিহাসের পাতাজুড়ে জীবনের লড়াই লড়ছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সামাজিক ও নৈতিক অভিঘাত সেখানে গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। ছবিতে ছিল বাণিজ্যিক নাটকীয়তার উপাদান—যেমন হারিয়ে যাওয়া ছেলে মৃত্যুর আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করছে, তখন জানতে পারছে সে নিম্নবর্ণের; অথবা সুবর্ণরেখায়—বোন পতিতাবৃত্তিতে নামছে, আর প্রথম ক্রেতা হিসেবে হাজির হলো তার বিচ্ছিন্ন ভাই। কিন্তু উপস্থাপনা ছিল একেবারে ভিন্ন—বাস্তবধর্মী লোকেশনে শুট, বাড়তি চাকচিক্যহীন, তবু কাব্যময়তায় ভরপুর।

ritwik_ghatak_3.jpg
ছবি: সংগৃহীত

এই কারণেই ঘটককে চাইছিলেন জগত। আর ঘটক কেন চাইছিলেন এফটিআইআই?

কারণ সে সময় তিনি জীবনের একদম নিম্নগামী পর্যায়ে ছিলেন। হাতে কোনো ছবি নেই, অসমাপ্ত পড়ে আছে 'বাগলার বঙ্গ দর্শন'। স্ত্রী অসুস্থ, তিনটি ছোট সন্তান, আর পকেট শূন্য। ইনস্টিটিউটের চাকরি তাকে শুধু নিয়মিত বেতনই দেবে না, বরং পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র বানানোর সুযোগও দেবে। আর ছবি বানানো তার কাছে ছিল প্রশ্বাস নেওয়ার মতো জরুরি।

স্ত্রী সুরমাকে লেখা তার চিঠিতে এ সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই চিঠিগুলো পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

১৯৬৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি লিখলেন:

'এখানে আমি সবার কাছ থেকে স্নেহ পাচ্ছি। দুনিয়ার একমাত্র জায়গা এটাই, যেখানে এখনো মানুষ আমাকে চায়। মুরারি বলেছে আমি যেকোনো সময় যোগ দিতে পারি।'

১৯৬৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর যখন তিনি প্রায় নিশ্চিত যে ভাইস প্রিন্সিপালের পদ পাবেন এবং কলকাতায় গিয়ে অসমাপ্ত ছবির কাজ শেষ করবেন, তখন লিখলেন:

'আমার একমাত্র লক্ষ্য হবে রমনের ছবি (বাগলার বঙ্গ দর্শন) শেষ করা। এরপর আর কোনো ছবি বানাতে চাই না। কলকাতা আর ভালো লাগে না। এখানে ইনস্টিটিউটে আমি নিয়মিত বেতন, সম্মান, আর পছন্দমতো কাজ পাব। গ্রীষ্মের ছুটির আগে যদি যোগ দিতে পারি তাহলে আফগানিস্তানে গিয়ে দুই মাসের জন্য একটি পরীক্ষামূলক ছবি করার সুযোগও পাব।'

তবে শেষ পর্যন্ত ঋত্বিক ঘটক এফটিআইআই ছেড়ে আসেন ১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর্থিক নিরাপত্তা থাকলেও নিয়মিত চাকরি তার ভালো লাগছিল না। তা ছাড়া, তিনি দিনশেষে সিনেমাটাই বানাতে চাইছিলেন। তবে ছেড়ে এলেও তার জীবনের বড় অস্থির এক সময়ে এফটিআইআই তাকে একটু স্থিরতা দিয়েছিল। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ঋত্বিক খুঁজে পেয়েছিলেন এমন একটি জায়গা, যেখানে তিনি স্বস্তি পাবেন; যারা তার মূল্য দিতে জানেন।