হতাশায় আলোর কবি ফররুখ আহমদ
কবি ফররুখ আহমদ বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তার কবিতার স্বরের মধ্যে এমন এক শক্তি আছে, যা তাকে সমসাময়িক কবিদের মধ্যে বিশেষ স্থান দান করেছে।
তিনি বাংলাদেশের কবিতা ও সাহিত্যালোচনায় সব সময়ই প্রাসঙ্গিক ছিলেন। তবে সাহিত্যের একার্থতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা ফররুখ আহমদসহ অনেক জরুরি সাহিত্যিকদের পাঠে যথাযথ মনোযোগী হইনি।
মনে রাখতে হবে, তার কবিতা অস্বীকার করলে এই জনগোষ্ঠীর এক সময়ের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে, আত্মমর্যাদার বাসনাকে, বাংলা কবিতার বিকাশের ধারাকে অস্বীকার করা হয়। প্রতিকূলতাকে জয় করে তার কবিতা মানুষের মননে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা ভাষা সংস্কৃতি যত দিন থাকবে, তার কবিতা বাঙালি মননের চিন্তার বাতিঘর হিসেবে দেখা দেবে। এই অভাগা কবির কাব্যপ্রতিভা টিকে থাকবে প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে।
কবিকে লালন-পালন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। তাকে ভরণ-পোষণ করে বিলাসী জীবন দেবে—তাও কাম্য নয়। অন্যদিকে জনসাধারণ চান না যে, সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে একজন কবি 'জ্বী হুজুর' বলুক। কবিরা স্বাধীনভাবে লিখবেন, তথা মত প্রকাশ করবেন। এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ও সরকারের দায়িত্ব। নাগরিক অধিকারের বাইরেও বিশিষ্টজনদের বিশেষভাবে সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
যদি কোনো সাহিত্যিকের জীবন বিপন্নের আশঙ্কা থাকে, তাহলে সরকারের দায়িত্ব তাকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া। এমন নৈতিকতার চর্চা হয়নি কোনো কোনো সমাজে। সেখানে অনেক কবি-লেখকের জীবন পর্যন্ত সংহার হয়েছে। অথচ তারাই অন্ধকারের আলোকবর্তিকা হিসেবে সমাজে কাজ করে যাচ্ছেন আবহমানকাল থেকে।
সভ্যতার ঊষালগ্ন তাদের দ্বারাই সূচিত। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ নিষ্পেষিত হয়েছেন সরকার কর্তৃক। এটা অন্যায়। তার কাব্যপ্রতিভার বিস্তার ঘটাতে এই অপকর্মের শাস্তি হওয়া উচিত।
কবি ফররুখ আহমদ বাঙালি সংস্কৃতির ঊষালগ্নের কবি। তিনি ইসলামি ভাবধারাকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের আনুকূল্য তিনি পাননি। বরং শিকার হয়েছেন প্রতিরোধের, প্রতিহিংসার।
তবুও তার কলম থেমে থাকেনি। আমৃত্যু তিনি আদর্শ প্রচার করে গেছেন। সাহিত্যজগতে কবি ফররুখ আহমদের মতো কবিভাগ্য বিরল। হতভাগ্য কবি তিনি। জুলুম-নির্যাতন ও অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। সত্যে ছিলেন অবিচল। সত্য-বিচ্যুত হননি কখনও।
গত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে তার কবিতা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনায় এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। অথচ বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদের মতো কবিকে সরকার ও রাষ্ট্র হুলিয়া জারি করেও দমিয়ে রাখতে পারে না। তিনি জনমানুষের কবি। মানুষের মুক্তির বার্তায় তার কবিতা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। মানুষের মনের গভীরে তিনি ঠাঁই নিয়েছেন।
১৯৪৫ সাল থেকে মোহাম্মদী পত্রিকাতে কাজ শুরু করেন, এরপর ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালে কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। এ সময় 'ছোটদের খেলাঘর' অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।
একবার বাংলাদেশ বেতার থেকেও তার চাকরি চলে যায়। এ সময়ে এগিয়ে এলেন আরেক কিংবদন্তী সাহিত্যিক আহমদ ছফা। 'ফররুখ আহমদের কী অপরাধ' শীর্ষক তীব্র ও তীক্ষ্ণ প্রতিবেদন লিখলেন গণকন্ঠ পত্রিকায়। ফলে কবিকে পুনর্বহাল করা হয়। তবে শেষ জীবনে কবি অবমূল্যায়ন ও ভয়াবহ অর্থসংকটে জীবনযাপন করেছেন।
ফররুখ আহমদ নির্যাতিত মানুষের মুক্তি ও মানবতার প্রতিও কবিতা লিখেছেন। তিনি তার কবিতায় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন এবং আরবি-ফারসি শব্দের নিপুণ ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করেছেন এক নতুন কাব্যিক ভাষা।
১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে লেখা তার 'লাশ' কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যে 'লাশ'-এর মতো কবিতা আর কেউ লিখতে পারেনি।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যথিত কবির উচ্চারণ—
যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প'ড়ে আছে জমিনের 'পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
ফররুখ আহমদের 'লাশ' কবিতাটি দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত, যা বাস্তবতার এক নির্মম ছবি তুলে ধরে। এই কবিতার শৈলী মূলত বাস্তববাদী ও প্রতীকী, যেখানে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা ও মানবিক বিপর্যয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবি বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লাশ ও মৃত্যুর ভয়াবহ চিত্র এঁকেছেন। যেমন: 'মুখ গুঁজে প'ড়ে আছে জমিনের পর' বা 'ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে প'ড়ে আছে নিঁসাড় নিথর' লাইনগুলো সরাসরি বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে।
লাশ এখানে শুধু মরদেহ নয়, বরং দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়া মানবতা ও সমাজের ধ্বংসের প্রতীক। যদিও এটি বাস্তববাদী, তবে এর ভাষা কাব্যিক ও আবেগময়। এটি শুধু একটি ঘটনার বর্ণনা নয়, বরং এর মধ্যে গভীর দুঃখ, হতাশা ও মানবতার প্রতি কবির সহানুভূতি নিহিত রয়েছে।
'লাশ নেবে লাশ!' এই পুনরাবৃত্তিমূলক স্লোগানটি কবিতার মূল সুরকে আরও শক্তিশালী করে এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাকে বারবার পাঠকের সামনে তুলে ধরে। পুরো কবিতাজুড়ে একটি বিষাদময় ও হতাশাজনক সুর বিদ্যমান, যা দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্ট গভীর দুঃখ ও শূন্যতাকে প্রকাশ করে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় আরবি, ফারসি শব্দের যে সার্থক প্রয়োগ শুরু করেন, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তা আরও বেগবান করেন। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃৎ তিনি। তার 'নৌফেল ও হাতেম' একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও সফল তিনি।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আর কোনো কবি এত বেশি সফল সনেট রচনা করতে পারেনি। তার সনেট গ্রন্থের মধ্যে 'মুহূর্তের কবিতা', 'দিলরুবা', 'অনুস্বার' প্রধান।
গদ্য কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি ফররুখ আহমদ। গদ্য কবিতার সংকলন 'হাবেদা মরুর কাহিনী' লিখে সফল তিনি। গীতিনাট্য 'আনার কলি'। সাত সাগরের মাঝি' বিস্ময়কর এক কবিতা গ্রন্থ। ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এটি। প্রকাশের এত বছর পরও এ গ্রন্থ সমানভাবে জাগ্রত ও প্রাণবন্ত। এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতা হলো 'পাঞ্জেরী'।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরী।
কবি ফররুখ আহমদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সমাদৃত 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থের ভাষা ও ভাষ্য, ব্যাকুলতা ও আবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কবি একইসঙ্গে মুসলিম সমাজকে অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে উজ্জীবিত করছেন, আবার তাদের পতিত জীবনযাপন দেখে ব্যথিত হয়েছেন।
তিনি তাদের সোনালি দিনের শোভা গ্রহণ করতে বলছেন, অতীতে ফিরে যেতে নিষেধ করছেন। আর অতীতে ফিরে না গিয়ে ঐতিহ্য ধারণের নামই সম্ভবত জাগরণ। এ ডাক দিয়ে যাওয়ায় ফররুখ আহমদ জাগরণের কবি। বাংলা সাহিত্যে 'হাতেম তায়ী' কবি ফররুখ আহমদের লেখা প্রায় সোয়া তিনশত পৃষ্ঠায় সমাপ্ত এক বিরাট মহাকাব্য।
কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। দরিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ-বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতোই ছিল কবির দৈনিক জীবন।
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।
তিনি তার কবিতায় সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা লিখে গেলেও তার জীবনে তাকে বহু দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয়েছে। মূলত ইসলামি আদর্শ লালন করার কারণেই তাকে এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে বলে মনে করা হয়। তার এক ছেলে ডাক্তারি পড়ছিলেন, টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এক মেয়ে মারা যান।
তখন রমজান মাস ছিল। টাকার অভাবে ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে না খেয়েই রোজা রাখতেন তিনি। এ অবস্থাতেই রমজান মাসে ইন্তেকাল করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই কবি।
তাকে কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক আসাফউদ্দৌলা রেজাসহ অনেকেই সরকারিভাবে কোনো জায়গা পাওয়া কি না, চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি।
অবশেষে কবি বেনজীর আহমদ তার শাহজাহানপুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করার জায়গা দান করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তার প্রতি চরম অবহেলা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করলেও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি প্রতিভার যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তা যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতির জীবনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কাব্যক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের যখন আবির্ভাব, তখন নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। জসীমউদ্দীন ও সমকালীন অন্য কবিদের তখন প্রবল দাপট। তার মধ্যেও ফররুখ আহমদ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
কাব্যের বৈচিত্র্য, শিল্পনৈপুণ্য আর রূপক উপমার অভিনব ব্যবহারে নিজস্ব এক কাব্যভাষা নির্মাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই কবিকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের শিল্প বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কাব্যের শিল্প বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়ে কাব্যচর্চা চালিয়েছেন।
