২৬ বছর নির্বাচনহীন বাংলা একাডেমি, তারিখ নিয়ে ভাবছেন মহাপরিচালক
যে উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে তা এখন প্রশ্নের মুখে। বইমেলার ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে যাওয়া, বই প্রকাশে রাজনৈতিক স্বার্থ ব্যবহার, পুরস্কারে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভিযোগসহ জনবল ও আর্থিক সংকট যেমন আছে, তেমনি স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার কথা থাকলেও মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাধারণ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের পরেও এই সংকট কাটেনি বলে একাডেমির সদস্য কবি, লেখক ও প্রকাশকদের অভিযোগ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলা একাডেমি চলছে পদাধিকারবলের ও মনোনীত সদস্যদের দিয়ে। ফেলো ও সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাহী পরিষদ গঠনে আইন থাকলেও ২৬ বছর ধরে নির্বাচনই হয় না। ফলে একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা-পরামর্শ, বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদনসহ নির্বাহী পরিষদের কাজ গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে হচ্ছে না এবং এর মাঝে বাড়ছে অনিয়মের সুযোগ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আইনজীবী, শিক্ষক, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এর মাঝে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে নির্বাচন না হওয়ায় গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ধারা চালু হচ্ছে না।
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, নির্বাহী পরিষদের সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলা একাডেমি আইন (২০১৩) অনুযায়ী, এই নির্বাচন ৩ বছর পরপর হওয়র কথা এবং সে হিসেবে এই পর্যন্ত আটটি নির্বাচন হওয়ার কথা।
বাংলা একাডেমি আইনের ২৩ নম্বর ধারাটি নির্বাহী পরিষদ বিষয়ে। এর ১ নম্বর উপধারা অনুযায়ী, মোট ১৯ সদস্য নিয়ে নির্বাহী পরিষদ গঠিত ও পরিচালিত হবে। ৩ নম্বর উপধারায় আছে, নির্বাচিত সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভার তারিখ হতে ৩ বছর মেয়াদের জন্য পরিষদের সদস্য হবেন। তারা দুই মেয়াদের বেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না।
নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনের মাধ্যমে একাডেমির ফেলোরা ৩ জন ফেলো ও সাধারণ পরিষদের সদস্যরা ৪ জনকে নির্বাচিত করবেন। এই ৭ জনই নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। কিন্তু এই ৭ নির্বাচিত সদস্য না থাকায় অনেক দিন ধরে নির্বাহী পরিষদ চলছে শুধু পদাধিকারবলের ও মনোনীত ১২ সদস্য দিয়ে। এই ১২ জনের মধ্যে দুজন পদাধিকারবলের সদস্য ও ২ জন নির্বাহী পরিষদ মনোনীত সদস্য। আর ৮ জন সরকার মনোনীত সদস্য। অনেক দিন ধরে এই ১২ জনই নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন।
বাংলা একাডেমি আইনে নির্বাহী পরিষদের কার্যাবলীর উল্লেখ আছে। এগুলো হলো একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান। একাডেমির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনে নীতিনির্ধারণ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন। সরকার বা সাধারণ পরিষদ প্রদত্ত অন্য কোনো দায়িত্ব পালন। ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, নির্বাহী পরিষদ তার কার্যাবলীর জন্য সাধারণ পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে।
২০২৩ সালের ২৮ জানুয়ারি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমির পুরস্কার ফেরত পাঠান। কারণ বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি নির্বাচনে অংশ নেওয়া অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বাংলা একাডেমি একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে এরশাদ পতনের পর সবাই প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ যথাযথ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখেনি। অবাক করার বিষয় হচ্ছে বাংলা একাডেমিতে কর্মচারীদের নির্বাচন হলেও ফেলো সদস্যদের নির্বাচন দেওয়া হয় না। কারণ, তাদের বক্তব্য বা মতামতকে ভয় পায় সরকার। সরকার এমন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছিলেন, তিনি ২০২১ সালে একাডেমিতে আসার পরই নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। নির্বাচনের নীতিমালার খসড়া করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় নির্বাচনের বিধিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করেছে।
তারপরে কি হয়েছে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কথা। বিধিমালা তৈরি করে যেহেতু একাডেমি দিয়েছেন মন্ত্রণালয়কে, এখন খুব বেশি কাজ নেই। কেবল সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করার পালা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ আজম। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা আছে নির্বাচন দেওয়ার। এই বছর হয়তো হবে না। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেভাবে আলাপ চলছে।
বাংলা একাডেমির ফেলো কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, একাডেমির নীতিমালা অনুসারে ফেলো ও সদস্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় নির্বাচন না হওয়া ভালো বিষয় না। এতে প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কাজের স্বচ্ছতা থাকে না, জবাবদিহি বিষয় আসে না। নির্বাচিত কবি লেখকদের মতামত থাকলে একাডেমি আরও গতিশীল হতো। আমি আশা করব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ধারা অব্যাহত রাখতে দ্রুত নির্বাচন দিবে একাডেমি।
গত ৫ জুলাই বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে সময়োপযোগী গুণগত পরিবর্তন ও সংস্কার আনতে লেখক, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে ১৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর সভাপতি লেখক, গবেষক ও অনুবাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা বাংলা একাডেমির প্রতিটি বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি, অনেক জটিল বিষয়েও নোট করছি, দক্ষতা, জবাবদিহিমূলক এবং যেমন একাডেমি চায় মানুষ এমন কাঠামো নিয়ে ভাবছি।
নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচন নিয়ে নিশ্চয় মহাপরিচালকদের আন্তরিকতার অভাব ছিল। ২৬ বছর নির্বাচন না হওয়া আইন ও বিধির মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটেছে। একাডেমির প্রতিটি আইন ও বিধি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘ সময় অনির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে একাডেমি পরিচালনা করা আপত্তিকর বিষয়। এমন অনেক ত্রুটি আমরাও পেয়েছি। বাস্তবে নির্বাচনের অভাবে স্বচ্ছতা আসেনি, অগণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়া হতাশনজক। এমনটা যেন আর না ঘটে সেভাবে কাঠামোর প্রস্তাব করব।
প্রায় এক বছর পর গতকাল একাডেমি নির্বাচনের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, 'আমরা একাডেমি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। গুরুত্ব দিয়ে দেখছি বিষয়টা। কবে একাডেমি নির্বাচন হতে পারে সে তারিখ নিয়ে ভাবছি।'


