যখন লিখতে পারি না, তখন কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করতে পারি না : কিরণ দেশাই
বুকার পুরস্কার জয়ের পর কিরণ দেশাই টানা দুই দশক কাটিয়েছেন একটি নতুন বই লেখায়। আবারও তিনি বুকার তালিকায় নাম তুলেছেন। সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ানে তার একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। যেখানে কথা বলেছেন নিউইয়র্কে ঘটে চলা অভিবাসন অভিযান নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে অনূদিত।
কথাসাহিত্যিক কিরণ দেশাই ২০০৬ সালে বুকার পুরস্কার জেতেন। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বই দ্য ইনহেরিটেন্স অব লস। বইটি প্রকাশের পর দেশাই কাজ করেন তৃতীয় বই নিয়ে। নামটিও দ্রুত ঠিক করেন দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি। শুরু থেকেই তিনি চেয়েছিলেন এটি হবে আধুনিক রোম্যান্স। তবে প্রেমের গল্প হলেও আদতে একেবারেই প্রচলিত রোম্যান্টিক নয়। বরং এতে থাকবে শ্রেণি, বর্ণ, জাতীয়তা ও সামাজিক টানাপোড়েন। কিন্তু বইটি শেষ করতে লেগে যায় প্রায় বিশ বছর।
দেশাই হাসতে হাসতে বলেন, 'একটা বইয়ে এত বছর সময় দিলে মানুষ বারবার খোঁজ নেবে। তারা ভাববে, আমি হয়তো কোনো সমস্যায় আছি। আমার এক প্রতিবেশী তো প্রায়ই আমাকে দেখে অবাক হতেন। তিনি প্রতিদিন দেখতেন, আমি ভোরে উঠে লিখতে বসি, ডেস্কেই নাশতা ও দুপুরের খাবার খাই, বিকেলে সামান্য বাজার বা ঘরের কাজ করি, আবার রাত পর্যন্ত লিখি। একদিন এসে বললেন, ঘর থেকে বের হতে হবে! এভাবে বই লিখলে তুমি পাগল হয়ে যাবে! এটা কোনো জীবন নয়!'
'৯০ বছর বয়সী এক চাচা বললেন, তোমার চেহারা ভবঘুরের মতো দেখাচ্ছে। হয়তো তিনি ঠিকই বলেছিলেন। তবুও আমি লিখেই যাচ্ছিলাম। কারণ লেখার মধ্যেই ছিল আমার সব ভালোবাসা।'
কিরণ দেশাই নিজেই অবাক হন, এই বইটি লিখতে এত সময় কেন লাগল। বইটি প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার, কিন্তু হিলারি ম্যান্টেল বা ডিকেন্স কিংবা টলস্টয় তো এর চেয়েও অনেক বড় বই লিখেছেন! তাদেরতো এত সময় লাগেনি! এটাই তাকে অবাক করে।
বইটি লেখার কথা ভাবতে ভাবতে ২০১৩ সাল নাগাদ নোট জমে দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার পৃষ্ঠা। তখন বুঝতে পারছিলেন না, কোন কোন অংশ নিয়ে গল্পে বুনবেন, কতটা অতীতে ফিরবেন, কতটা ভবিষ্যতে যাবেন, সোনিয়া-সানির বাইরের চরিত্রদের কতটা জায়গা দেবেন।
তিনি বলেন, 'এটা মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বই। আবার শুরু করার মতো সময় নেই।'
যখন এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না, তখনও তিনি টানা লিখে গেছেন। তার ভাষ্য, 'এটা ছিল এক ধরনের একগুঁয়েমি। আমি যখন লিখতে পারি না, তখন অস্থির হয়ে যাই। কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করতে পারি না।'
বুকার পুরস্কার জেতার পর বছর দুয়েক তিনি এক ধরনের চাপে ছিলেন। সেটা ছিল আরও ভালো কিছু লেখার চাপ। অবশ্য পরে সেই চাপ থেকে বের হতে পারেন। তারপর বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন শুরু করেন, আর একাগ্রভাবে লিখে যান। সন্তান বা পারিবারিক দায়িত্ব না থাকায় এভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তখন প্রতিদিন মাকে ফোন করতেন, মাঝে মাঝে আপস্টেট নিউইয়র্কে গিয়ে দেখা করতেন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সপ্তাহে কয়েকবার দেখা হতো। কিন্তু মূলত একাই কাটিয়েছেন বছরগুলো। কখনও নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটে, কখনও মেক্সিকোতে দীর্ঘ সফরে।
দেশাই বলেন, 'এতটাই একাকী ছিলাম যে, সামাজিক পরিচয়টাই যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিজেকে নারী, ভারতীয় বা কোনো জায়গার মানুষ হিসেবে ভাবতাম না। কারণ একাকিত্বের মাঝে এসব ভাবনার কোনো মানে নেই।'
কুইন্সের শান্ত এক রাস্তায় তার বাসা। যেখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আলো খুঁজতেন। ঘরের ভেতর এক ডেস্ক থেকে আরেকটিতে চলে যেতেন। সদ্য যুক্তরাজ্য সংস্করণের বইয়ের কপি তার কাছে এসে পৌঁছেছে। অথচ এখনো সেই বক্স পড়ে আছে দরজার পাশে।
তিনি বলেন, 'এখনও মনে হয়, ওহহ, গল্পের ওই অংশটা বাদ দিয়ে যদি অন্যভাবে সাজাতাম, হয়তো আরও ভালো হত!'
২০০৬ সালে যখন তিনি বুকার জেতেন, তখন তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী নারী বিজয়ী। এখন তার বয়স ৫৪ বছল। এখন তিনি শান্ত, পরিমিত ভঙ্গিতে কথা বলেন। বই শেষ করার অনুভূতি তার কাছে ছিল খানিকটা 'অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স'।
তার ভাষ্য, 'কারণ এতদিন আমি ছিলাম একেবারে শিল্পের জগতে। এখন আবার সাধারণ জীবনে ফিরতে হচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছি না।'
দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি তার আগের বইয়ের মতোই বিস্তৃত পারিবারিক কাহিনি। যেখানে রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নও এসেছে। সোনিয়া ও সানি দুজনেই ভারতীয়, পড়ালেখার জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। একসময় সোনিয়ার পরিবার সানির কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু সানি তখন এক আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে। তার পুরোনো প্রথায় কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে সোনিয়া জড়িয়ে পড়ে বয়সে অনেক বড়, স্বার্থপর, নির্যাতনপ্রবণ শিল্পী ইলান দে টরজেন ফসের সঙ্গে।
এই উপন্যাসে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো প্রায়ই হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংসাত্মক, অসম, শ্বাসরুদ্ধকর। তা সেটা রোমান্টিক হোক বা পারিবারিক। গল্পের চরিত্ররা শিল্পকলা থেকে মুক্তি খুঁজতে চায়, কিন্তু শিল্পও কখনও হয়ে ওঠে শোষণের জায়গা।
দেশাই নিজেও মনে করেন, শিল্প কখনও হয়ে ওঠে শোষণের জায়গা। শিল্পে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এই অভিজ্ঞতা তার জীবনে ঘটেছে।
তিনি বলেন, 'আমি সেই বিনিময় করেছি। আফসোস নেই, কিন্তু এটা জীবনের অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে। অথবা হয়তো আমি জীবনটা এর মধ্যেই পূর্ণ করেছি।'
তার শৈশব কেটেছে দিল্লিতে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। বাবা ছিলেন একটি তেল কোম্পানিতে চাকরিজীবী। মা সামাজিক দায়িত্ব সামলাতেন, তবু লিখতেন। তার মা অনিতা দেশাই, তিনবার বুকারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
কৈশোরে কিরণ মায়ের সঙ্গে প্রথমে ক্যামব্রিজ, পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। নতুন সমাজব্যবস্থা তাকে ভীষণ বিস্মিত করে। ভারতের তুলনায় আমেরিকান স্কুল ব্যবস্থা তার কাছে সহজ মনে হয়েছিল। এরপর ভেরমন্টের বেনিংটন কলেজে পড়ার সময় তিনি সৃজনশীল লেখালিখি শুরু করেন।
প্রথম বই হাল্লাবলু ইন দ্য গুয়াভা অরচার্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএফএ করেন। সেখানে তিনি বুঝলেন নিয়মিত সমালোচনা লেখককে আত্মসচেতন করে। তারপর সাত বছর ধরে লেখেন দ্য ইনহেরিটেন্স অব লস। তার মা-ই ছিলেন প্রথম পাঠক।
নতুন উপন্যাসে ছিল নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। ভারতকে পশ্চিমা পাঠকের সামনে কীভাবে উপস্থাপন করবেন? তিনি অবশেষে সাজানো বিয়ে ও সামান্য ম্যাজিক রিয়ালিজমও রেখেছেন। কারণ এগুলো ভারতের বাস্তবতারই অংশ।
দেশাইয়ের মতে, 'ভারতের বেশিরভাগ বিয়ে পারিবারিকভাবে হয়। এটাই সত্য। কিন্তু পশ্চিমা পাঠকের জন্য লিখলে কি সেটা বাদ দেবেন? এখানেই লেখককে মুন্সিয়ানা লড়াইটা করতে হয়, মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়।'
২০০৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর ভারতে খুব বেশি ফেরা হয়নি তার। এবারকার বইয়ে তিনি ভারতকে সহস্রাব্দের শুরুর সময়ে একবার ধরে রাখতে চেয়েছেন। যখন দেশটিতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান হচ্ছিল। তার মতে, ভয় যখন জাতির ভেতরে ঢুকে যায়, তখন প্রায় সবকিছু শেষ হয়ে যায়। আর তিনি কখনও ভাবেননি একই ভয় আমেরিকায়ও দেখতে হবে। এখন তার জ্যাকসন হাইটসের এলাকায় অভিবাসন অভিযানের কারণে অনেকেই আতঙ্কিত। যে দৃশ্য কিরণকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
তবুও তিনি ভালোবাসেন এই বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ে বাস করতে। তার প্রতিবেশী ছিলেন আয়ারল্যান্ড, তিব্বত, মিশরের মানুষ। সেখানেই তিনি খুঁজে পান গল্প ও সঙ্গ।
প্রতিদিন বিকেল সাড়ের ৪টায় তার মা ফোন করেন। ৮৮ বছর বয়সী অনিতা দেশাই এখন কিছুটা অসুস্থ, কয়েকবার পড়েও গেছেন। মেয়ের নতুন বই প্রকাশে ভীষণ খুশি তিনি। কিন্তু কিরণের বারবার ভ্রমণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন মা অনিতা দেশাই।
দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি ইতোমধ্যেই বুকার লংলিস্ট ও পরে শর্টলিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। দেশাই বলেন, 'এটা যেন এক অজানা বিপদ থেকে বেঁচে যাওয়া। আমি ভাগ্যবান।'
তবে তিনি জানেন, আর কখনও এত বিশাল কিছু করা সম্ভব নয়। কিরণ বলেন, 'এটাই মনে হয় আমার জীবনের বড় বই। আরেকবার এভাবে লেখার সময় পাব না।'