কচুরমুখীর এই পুষ্টিগুণগুলো জানেন?
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত একটি পুষ্টিকর সবজি হলো কচুরমুখী। স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণ—সবদিক থেকেই এটি একটি বহুমাত্রিক খাদ্য উপাদান। সাধারণত ভর্তা, ভাজি, চচ্চড়ি, ঝোল বা ভুনায় ব্যবহৃত হলেও এর উপকারিতা অনেকেই জানেন না। অনেকে আবার কচুরমুখীকে অপছন্দের তালিকাতেও রেখে থাকেন।
চলুন আজকে জেনে নেই কচুরমুখীর উপকারিতা। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন মিরপুর জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টিবিদ তারানা জান্নাত মুমু।
তিনি বলেন, কচুরমুখীতে থাকা কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ভিটামিন–মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের প্রতিটি অংশে উপকার করে—হৃদরোগ প্রতিরোধ থেকে হজম, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, দৃষ্টিশক্তি, ত্বক–চুল, হাড় পর্যন্ত। সঠিকভাবে রান্না ও পরিমিত পরিমাণে খেলে কচুরমুখী হতে পারে প্রতিদিনের খাবারের একটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর সংযোজন।
১০০ গ্রাম কচুরমুখীর পুষ্টিমান
ক্যালরি ৯৭ কিলোক্যালরি
কার্বোহাইড্রেট ২৩–২৪ গ্রাম
ফাইবার ৪.১ গ্রাম
প্রোটিন ১.৫–১.৮ গ্রাম
ফ্যাট ০.২ গ্রাম
ক্যালসিয়াম ৪৩ মিলিগ্রাম
আয়রন ০.৬–১ মিলিগ্রাম
পটাশিয়াম ৪৮৪ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম
ভিটামিন–সি ৫–৬ মিলিগ্রাম
ভিটামিন–এ (বিটা-ক্যারোটিন) ৩০০–৪০০ আইইউ
ভিটামিন–বি কমপ্লেক্স সামান্য পরিমাণ
এই পুষ্টি উপাদানগুলো কচুরমুখীকে শুধু খাবার নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যরক্ষক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে।
কচুরমুখীর স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. হজম শক্তি উন্নত করে
কচুরমুখীর ৪ শতাংশের বেশি ফাইবার অন্ত্রের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে। দীর্ঘমেয়াদে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। গ্যাস্ট্রিক, বদহজম ও অ্যাসিডিটির ঝুঁকি কমায়। অন্ত্রের সুস্থ ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি সহায়তা করে। দীর্ঘদিনের অনিয়মিত হজমের সমস্যায় কচুরমুখী নিয়মিত খাওয়া উপকারী।
২. রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
কচুরমুখীর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। ফলে খাওয়ার পর রক্তে শর্করা ধীরে বাড়ে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ নিরাপদ। ফাইবার ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়। ডায়াবেটিস রোগীরা কচুরমুখী রান্নায় তেল ও আলু কম ব্যবহার করতে পারেন।
৩. হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৪৮৪ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পাওয়া যায়, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। পটাশিয়াম সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব কমায়। রক্তনালীর স্বাভাবিক টেনশন বজায় রাখে। হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দ ধরে রাখতে সাহায্য করে। যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাদের খাবারে কচুরমুখী উপকারী হতে পারে।
৪. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
কচুরমুখীর ভিটামিন–সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি–র্যাডিক্যাল ধ্বংস করে। সর্দি–কাশি ও সাধারণ সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। ত্বককে সতেজ রাখে। কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী।
৫. চোখের দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করে
বিটা–ক্যারোটিন ভিটামিন–'এ'-এর পূর্বধাপ, যা রাতকানা প্রতিরোধ করে, চোখের রেটিনা শক্তিশালী রাখে। শিশুদের দৃষ্টিশক্তি বিকাশে সহায়তা করে। যাদের চোখ শুষ্ক হয়, তারা খাবারের তালিকায় কচুরমুখী রাখতে পারেন।
৬. হাড় ও দাঁতের সুস্থতা
কচুরমুখীতে যথেষ্ট পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে। হাড়কে মজবুত করে। দাঁতের এনামেল শক্ত রাখে। বয়সজনিত হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকি কমায়। এটি বিশেষ করে বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য উপকারী।
৭. রক্তশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে
কচুরমুখীর আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে। নারী ও শিশুদের অ্যানিমিয়ার ঝুঁকি কমায়। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় আয়রন ঘাটতি পূরণে এটি একটি সহায়ক খাবার।
৮. ত্বক, চুল ও নখের জন্য উপকারী
কচুরমুখীতে থাকা ভিটামিন–সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খনিজ ত্বকের কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। রিঙ্কেল কমায়, চুল মজবুত করে, নখ ভাঙা প্রতিরোধে সহায়ক। যাদের চুল পড়া বা ত্বক শুষ্কতার সমস্যা আছে, তারা কচুরমুখী খেলে উপকার পাবেন।
৯. ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
কচুরমুখী দ্রুত পেট ভরায়, ক্যালরি তুলনামূলক কম। ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে। দীর্ঘক্ষণ তৃপ্তি দেয়। ওজন কমানোর ডায়েটেও এটি রাখা যায়, তবে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
১০. শক্তি বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে
কচুরমুখী ভিটামিন বি–কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ। শরীরের শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে। মানসিক ক্লান্তি কমায় ও স্নায়ু ও মস্তিষ্ককে সচল রাখে। শিক্ষার্থী, গৃহিণী ও কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী।
কচুরমুখী খাওয়ার পদ্ধতি
১. সিদ্ধ করে ভর্তা
হালকা লবণ দিয়ে ভালোভাবে সিদ্ধ করে সরষের তেল, পেঁয়াজ, মরিচ মিশিয়ে খেলে হজম সহজ হয়।
২. ভাজি বা চচ্চড়ি
পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ দিয়ে হালকা তেলে ভাজলে স্বাদ বাড়ে। খুব বেশি তেল ব্যবহার না করাই ভালো।
৩. ডাল বা মাছে রান্না
ডালে কচুরমুখী দিলে ঘনত্ব বাড়ে। ছোট মাছের সঙ্গে রান্না করলে পুষ্টিমান বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
৪. মাংসের সঙ্গে
গরু বা মুরগির মাংসের সঙ্গে কচুরমুখী রান্না পুষ্টিকর একটি খাবার।
৫. কচুরমুখীর স্যুপ
শিশু ও বয়স্কদের জন্য এটি খুবই হালকা ও হজমে সহজ।
সতর্কতা
১. অক্সালেট ক্রিস্টালের ঝুঁকি
কচুরমুখীতে অক্সালেট ক্রিস্টাল থাকে, যা অপর্যাপ্ত রান্নায় জিহ্বা বা গলায় জ্বালা, চুলকানি, খুসখুস ভাব সৃষ্টি করতে পারে। তাই ভালোভাবে ধুয়ে ও পর্যাপ্ত সময় সিদ্ধ বা রান্না করতে হবে।
২. কিডনির রোগীদের সতর্কতা
অক্সালেট কিডনিতে পাথরের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যাদের কিডনি সমস্যা আছে, তারা নিয়মিত খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
৩. অতিরিক্ত খেলে হজমে সমস্যা
খুব বেশি খেলে গ্যাস বা অস্বস্তি হতে পারে। তাই পরিমিত পরিমাণে খাওয়াই উত্তম।
৪. শিশুদের ক্ষেত্রে
শিশুর বয়স ৭–৮ মাসের আগে না দেওয়া ভালো। প্রথমদিকে পাতলা করে দেওয়া উচিত।



