আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু কী, ‘৩আই/অ্যাটলাস’ নিয়ে এত জল্পনা কেন?
রাতে অন্ধকার আকাশে উজ্জ্বল তারাদের দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবি—পৃথিবীর বাইরেও হয়তো কোনো জগৎ আছে। কখনও কখনও সুদূর নক্ষত্রমণ্ডলের কোনো কোনো বস্তু আমাদের কাছেও চলে আসে। এগুলোকেই আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু বা ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট বলা হয়।
আমাদের সৌরজগতে যে গ্রহ, গ্রহাণু বা ধূমকেতুগুলো ঘুরে বেড়ায়, তারা সবাই সূর্যের মহাকর্ষে বাঁধা। কিন্তু আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু হলো এমন অতিথি, যারা দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ছুটে এসে সূর্যের পাশ দিয়ে চলে যায়।
২০১৭ সালে প্রথমবার এমন এক অচেনা যাত্রী ধরা পড়ে—নাম ১আই/ওউমুয়ামুয়া (1I/Oumuamua)। অদ্ভুত আকার ও গতির কারণে অনেকেই একে ভিনগ্রহীদের মহাকাশযান বলে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি সম্ভবত এক টুকরো শিলাময় বস্তু, যা অন্য কোনো নক্ষত্রমণ্ডলের ভগ্নাংশ।
এরপর ২০১৯ সালে শনাক্ত হয় ২আই/বরিসভ (2I/Borisov)। এবার কোনো সন্দেহের অবকাশ ছাড়াই স্পষ্ট লেজ ও কোমা (গ্যাসীয় মেঘ) দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একে আমাদের সৌরজগতের বাইরের প্রথম ধূমকেতু হিসেবে ঘোষণা করেন।
পৃথিবীর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? শনাক্ত করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু পৃথিবীর জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকির উৎস হলেও, সেই ঝুঁকি এখন পর্যন্ত খুবই কম। তবে এগুলোকে শনাক্ত ও অধ্যয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো আমাদের সৌরজগতের বাইরের মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিরল ও মূল্যবান তথ্য দেয়।
আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে (প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০–৫০ কিলোমিটার) সৌরজগতের মধ্যে প্রবেশ করে। যদি কখনও এর কোনো বড় অংশ পৃথিবীর কক্ষপথ অতিক্রম করে এবং সংঘর্ষের পথে থাকে, তবে গুরুতর আঘাত ঘটাতে পারে। তবে এ পর্যন্ত যত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু পাওয়া গেছে, তারা পৃথিবীর কাছাকাছি আসেনি এবং সংঘর্ষের ঝুঁকি ছিল প্রায় শূন্য।
গবেষণা বলে, কয়েক দশক পরপর একটি ছোট আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু সৌরজগতে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা এক বিলিয়নে এক বা তারও কম। অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে এগুলো থেকে বাস্তবিক কোনো বিপদ নেই।
কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এ ধরনের বস্তু জৈব পদার্থ বা অ্যামাইনো অ্যাসিড বহন করতে পারে। তাই এগুলো হতে পারে 'প্যান্সপারমিয়া তত্ত্ব' (যে ধারণা বলে জীবনের উপাদান মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে) প্রমাণের সম্ভাব্য উৎস।
৩আই/অ্যাটলাস
সম্প্রতি তৃতীয় এক অতিথি ৩আই/অ্যাটলাস (3I/ATLAS) বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। গত ১ জুলাই চিলির রিও হুরতাদো অঞ্চলে অবস্থিত অ্যাটলাস মহাকাশ পর্যবেক্ষণ স্টেশনে ধূমকেতুটি ধরা পড়ে।
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা বলছে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি প্রায় ১ দশমিক ৮ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক (পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্বের সমান, প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূরত্ব দিয়ে যায়—যা প্রায় ১৭ কোটি মাইল সমান।
গত ৩০ অক্টোবর সূর্যের নিকটতম বিন্দুতে পৌঁছায় ধূমকেতুটি। তখন সূর্য থেকে এর দূরত্ব ছিল প্রায় ১ দশমিক ৪ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক—অর্থাৎ প্রায় ১৩ কোটি মাইল। মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথের সামান্য ভেতর দিয়ে এটি চলে যায়।
৩আই/অ্যাটলাস নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে তুলেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভি লোব। তিনি অভিযোগ করেন, নাসা বস্তুটির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছে। এই বিতর্কে নাম লেখান মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্কও।
যদিও প্রমাণ বলছে—এটি একটি ধূমকেতু, কোনো ভিনগ্রহী যান নয়। এর রাসায়নিক গঠন ও গতি আমাদের পরিচিত ধূমকেতুর মতোই, শুধু এসেছে অন্য নক্ষত্রমণ্ডল থেকে।
তারা এসে আবার চলে যায়, কিন্তু রেখে যায় অনন্ত এক প্রশ্ন—অজানা এই মহাবিশ্বে আমরা একা নাকি অসংখ্য জগতের অংশ?
বিবিসি বলছে, আমাদের সৌরজগতের অভ্যন্তরে হঠাৎ করে কোনো অচেনা নক্ষত্রমণ্ডল থেকে আসা বস্তু সবসময়ই প্রচণ্ড আগ্রহ ও নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়।
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এমন তৃতীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু ৩আই/অ্যাটলাসও এর ব্যতিক্রম নয়।
কেউ কেউ একে ভিনগ্রহীদের মহাকাশযান বলে দাবি করলেও অধিকতর পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, এটি একটি ধূমকেতু—মিল্কিওয়ের দূর প্রান্ত থেকে আসা কোনো যান্ত্রিক যান নয়।
ধূমকেতুটির গঠন
এনওআইআর ল্যাব শিক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেমিনি সাউথ টেলিস্কোপসহ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে—৩আই/অ্যাটলাসের স্পষ্ট একটি কোমা ও লেজ আছে, যা প্রকৃত এক ধূমকেতুর স্বাক্ষর বহন করে।
সেই কোমা ও লেজ কোনো আলো-ছায়ার বিভ্রম বা পর্যবেক্ষণগত ভুল নয়। এগুলো আসলে উদ্বায়ী পদার্থ—গ্যাস ও জলীয় অণু, যেগুলো সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হয়, যখন ধূমকেতুটি সৌরজগতের ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়।
ধূমকেতুর মধ্যে পানি, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অ্যামোনিয়ার মতো বরফজাত পদার্থ থাকে। যখন এগুলো সূর্যের কাছে আসে, বরফজাত পদার্থ কঠিন অবস্থা থেকে সরাসরি গ্যাসে রূপান্তরিত হয় এবং ধূলিকণাকে সঙ্গে নিয়ে উজ্জ্বল কোমা ও লম্বা লেজ তৈরি করে।
৩আই/অ্যাটলাসকে নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্ক নরিসের ভাষ্য, শুধু এক নজর দেখলেই বোঝা যায়—এর লেজ আছে, যা একে গ্রহাণু থেকে আলাদা করে, কারণ গ্রহাণুতে এ ধরনের বরফীয় বৈশিষ্ট্য থাকে না।
মহাকাশে ধূমকেতুটির স্বাভাবিক যাত্রা
৩আই/অ্যাটলাস দেখতে যেমন ধূমকেতুর মতো, তেমনি এর গতিবিধিও তেমন—এতে কোনো অস্বাভাবিক বা কৃত্রিম শক্তির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন, এতে কোনো ঠেলা বা দিক পরিবর্তনের প্রমাণ নেই—শুধু সূর্যের মহাকর্ষ ও প্রাথমিক গতিপথ অনুযায়ী চলছে।
মার্ক নরিস বলেন, যদি এটি আমাদের মতো কোনো বুদ্ধিমান প্রাণের তৈরি যন্ত্র হতো, তবে এটি ধুলা ও বরফের কোমায় ঢাকা থাকত না এবং নিশ্চয়ই গ্রহগুলোর কাছাকাছি এসে চলাচল করত।
বাস্তবে ধূমকেতুটি শুধু সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে মহাকাশ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ভেসে যাচ্ছে—যেমনটি একটি প্রাকৃতিক বস্তু করে থাকে।
রাসায়নিক গঠনও একই বার্তা দিচ্ছে
স্পেকট্রোস্কপি হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ—যার মাধ্যমে তারা দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে গ্রহের উপাদান পর্যন্ত সবকিছুর রাসায়নিক তথ্য জানতে পারেন।
এই পদ্ধতিও প্রমাণ করে যে ৩আই/অ্যাটলাসের সঙ্গে ভিনগ্রহীদের কোনো সম্পর্ক নেই। ভেরি লার্জ টেলিস্কোপের (ভিএলটি) সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে—এতে এমন অণু আছে যা আমাদের সৌরজগতের ধূমকেতুগুলোর মতো।
ল্যাঙ্কাশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার মার্ক নরিস আরও বলেন, এর রাসায়নিক উপাদানের অনুপাত কিছুটা ভিন্ন, তা সম্ভবত এর নিজস্ব নক্ষত্রমণ্ডলের পরিবেশ ও রাসায়নিক গঠনের পার্থক্যের কারণে—এটা ভিনগ্রহী প্রযুক্তির প্রমাণ নয়।
অচেনা এক নক্ষত্রমণ্ডলে এক ঝলক
বিবিসি বলছে, এই পর্যবেক্ষণগুলো স্পষ্টত জানাচ্ছে—৩আই/অ্যাটলাস একটি সাধারণ ধূমকেতু, কোনো ভিনগ্রহী মহাকাশযান নয়। তবে এটি বিজ্ঞানের জন্য এক অমূল্য সুযোগ এনে দিয়েছে।
এটি অচেনা এক নক্ষত্রমণ্ডলের বাইরের অঞ্চলের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে জানার এক বিরল সুযোগ দিচ্ছে। এর গঠনকে আমাদের সৌরজগতের ধূমকেতুর সঙ্গে তুলনা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রমণ্ডলের বাইরের অংশ কীভাবে গঠিত হয়, তা যাচাই করতে পারেন।
ফলে তারা বুঝতে পারবেন—আমাদের সৌরজগত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির শত শত কোটি নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যে সাধারণ নাকি ব্যতিক্রম।
আমাদের সৌরজগতের বয়স প্রায় ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর। জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্ক নরিসের ধারণা, ৩আই/অ্যাটলাস সম্ভবত সৌরজগতের চেয়েও কয়েক শত কোটি বছর পুরোনো।
গত জুলাইয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় এর বয়স প্রায় ৭ দশমিক ৬ থেকে ১৪ বিলিয়ন বছর (অর্থাৎ ৭৬০ কোটি থেকে ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর) এর মধ্যে বলে ধারণা করা হয়েছে।
মার্ক নরিস বলেন, যদি তা-ই হয়, তবে এটি এমন এক নক্ষত্রকে ঘিরে গঠিত হয়েছিল যা সূর্যের অনেক আগেই জন্মেছিল—তখন গ্যালাক্সিতে কম প্রজন্মের নক্ষত্র ছিল এবং ভারী মৌলও আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল।
তাই ধারণা করা যায়, আমাদের সৌরজগতের ধূমকেতুগুলোর তুলনায় ৩আই/অ্যাটলাসে ভারী মৌলের পরিমাণ কম থাকবে।
নক্ষত্রগুচ্ছ এবং গ্যালাক্সির গঠন ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা করা এই অধ্যাপকের মতে, এই প্রাচীন আন্তঃনাক্ষত্রিক অতিথিকে অধ্যয়ন করে আমরা গ্যালাক্সির আরও প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি—কোনো ভিনগ্রহী তত্ত্ব বা অদ্ভুত ব্যাখ্যা ছাড়াই।
আন্তঃনাক্ষত্রিক বিস্ময়
এ পর্যন্ত সব পর্যবেক্ষণই প্রমাণ করছে—৩আই/অ্যাটলাস একটি ধূমকেতু, অন্য নক্ষত্র থেকে আসা প্রাচীন বস্তু, কোনো ভিনগ্রহী দর্শনার্থী নয়।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতুই গ্যালাক্সির অন্য কোনো প্রান্তের অজানা কোনো জানালা খুলে দেয়।