বিশ্বজুড়ে ভূতেদের যত উৎসব

কৌরিত্র তীর্থ
কৌরিত্র তীর্থ
31 October 2023, 08:26 AM
UPDATED 31 October 2023, 18:02 PM

'ভূত হওনের পর ফূর্তি করন যাইব না, এই কথা কইলডা কেডা?' অনীক দত্তের বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'ভূতের ভবিষ্যতে' (২০১২) ফূর্তিবাজ ভূত, ভূতনাথ ভাদুড়ী অত্যন্ত যৌক্তিক এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। ভূতেদের ফূর্তি 'করনের' অধিকার নিয়ে কারও আপত্তির বিশেষ কোনো কারণ নেই। কিন্তু ভূতেরা আদৌ ফূর্তি করে কি? 

উত্তর জানা যায় না। তবে ভূতেদের কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে দেহধারী মানুষেরা যে নানারকম মচ্ছবে মেতে ওঠেন, তার উদাহরণ কিন্তু অসংখ্য। 

মার্কিন হ্যালোউইনের সঙ্গে তো আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। তবে এর বাইরেও ভূত-প্রেত-আত্মাকে লক্ষ্য করে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে যে উৎসবগুলো আয়োজিত হচ্ছে, তারই কয়েকটার খবর আজ জানা যাক- 

দিয়া দে লস মুয়েরতস 

জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির স্পেকটার (২০১৫) চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্যটি হয়তো অনেকের মনে থাকবে। সেখানে দেখা যায়, কঙ্কালের মুখোশ পরিহিত হাজার হাজার মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এটি মেক্সিকোর 'দিয়া দে লস মুয়েরতস' বা, 'মৃতদের দিন' উদযাপনের চিত্র। মূলত পরিবারের মৃত সদস্যদের স্মরণে এ উৎসবটি পালিত হয়। মেক্সিকোর পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও নভেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন মানুষদের মোমবাতি, কঙ্কাল ও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য হাতে রাস্তায় নামতে দেখা যায়। 

haaland

বিশ্বাস করা হয়, অক্টোবরের ৩১ তারিখ মধ্যরাতে স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হয় এবং মৃত আত্মারা ২৪ ঘণ্টার জন্য নিজেদের স্বজনের কাছে ফিরতে পারে। তাদের ফেরাকে স্বাগত জানাতে প্রায় প্রতিটি বাসায় একটি বেদী প্রস্তুত করে তাতে মোমবাতি, ফুল, মৃতের পছন্দের খাদ্য, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। এরপর স্বজনেরা কঙ্কালের মুখোশ পরে, হরেকরকম খাদ্যসামগ্রী নিয়ে, গান গাইতে গাইতে মৃতের সমাধির উদ্দেশে রওয়ানা দেন প্রার্থনার জন্য। 

এই উৎসবে কঙ্কালের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। বিরাট আকারের কঙ্কালের কাটআউট, প্লাস্টিকের কঙ্কালের মুখোশ কিংবা মাটির তৈরি পুতুল কঙ্কালের মাথা- কোনকিছুরই অভাব নেই। এর কারণ হলো, মেক্সিকানরা এই দিনে মৃতদের শান্তি কামনার পাশাপাশি এটিও নিজেদের স্মরণ করায় যে, মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ এবং সকলেই একদিন এর স্বাদ গ্রহণ করবে।  

কুকেরি 

ভূতেদের উৎসবে সাজপোশাকের বৈচিত্র্য তো থাকেই। তবে প্রতি বছর জানুয়ারিতে বুলগেরিয়ায় উদযাপিত 'কুকেরি' বোধহয় এ ক্ষেত্রে আরেক কাঠি সরেস। এটি পালনের জন্য বিভিন্ন প্রাণির পশম, দাঁত, শিং, রঙবেরঙের সুতো, ভাঙা কাচের টুকরো এবং বিচিত্র অলংকার মিশিয়ে তৈরি হয় ভয়ংকরদর্শন সব পোশাক। এগুলোর কোমরে আবার বাঁধা থাকে প্রমাণ সাইজের ঘণ্টা। সব মিলিয়ে একেকটি পোশাকের ওজন ৮০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।   

covid 19.jpg

প্রাচীনকালে বুলগেরিয়ান পুরুষেরা এই বিশেষ ধরনের পোশাক পরে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতেন। কিন্তু এখন সে চল আর নেই। এখন বছরের নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট স্থানে বহু মানুষ একত্রিত হয়ে নেচে-গেয়ে এই প্রথা উদযাপন করেন। বর্তমানে কুকেরির সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় দেশটির পারনিক শহরে। 

বুলগেরিয়ানদের বিশ্বাস হলো, এই মুখোশ ও সাজপোশাক এতটাই ভয়ংকর যে এগুলো দেখে সত্যিকারের দানবেরা হাঁক ছেড়ে পালায়, ফলে সমাজে নেমে আসে শান্তি ও সৌভাগ্য।  

ঝং ইউন জি 

চৈনিক এই শব্দবন্ধের বাংলা হলো 'ক্ষুধার্ত ভূতেদের উৎসব'।  চন্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম মাসটিকে ধরা হয় ভূতেদের মাস; ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যার ব্যাপ্তি ১৬ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রচলিত বিশ্বাস, এই মাসে মৃত আত্মাদের পৃথিবীতে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তারা বেশ ক্ষুধার্ত থাকে বিধায় পরিবারের সদস্যরা তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেয়। 

made_in_bangladesh_tag_1.jpg

তবে এই মাস কেবল খাদ্য নিবেদনেরই নয়, মৃত আত্মীয়দের মনোরঞ্জনের জন্য এ সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবও আয়োজনও করা হয়ে থাকে। তখন দর্শকসারিতে সামনের কিছু আসন ফাঁকা রাখা হয় আত্মাদের বসবার জন্য। এ সময় ফানুস উড়িয়ে তাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়। এ ছাড়া নকল টাকা, কাপড়, ছোট ভাস্কর্য ইত্যাদি পোড়ানো হয়, যাতে আত্মারা জীবিত অবস্থার স্বাচ্ছন্দ্য আরেকবার উপভোগ করতে পারে। 

ফিয়েস্তা দে লাস নাতিতাস

বলিভিয়ার আয়মারা জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মোট সাতটি আত্মা রয়েছে, যার মধ্যে একটির অবস্থান হলো তার মাথার খুলিতে। তাই এই আত্মাকে সম্মান জানানোর জন্য প্রতিবছর আট নভেম্বর হাজার হাজার মানুষ মাথার খুলি নিয়ে জড়ো হন বলিভিয়ার লা পাজ শহরে। খুলিকে ফুল, টুপি, চশমা ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের কবরস্থান সংলগ্ন চার্চে। সেখানে পাদ্রী খুলিটিকে আশীর্বাদ করেন। সাধারণের মধ্যে বিশ্বাস হলো, এর ফলে মানুষ বহুবিধ বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পায়।  

Binturong.jpg

উল্লেখ্য যে, এখানে সত্যিকার খুলি ব্যবহৃত হয় এবং সবসময় সেটি যে মৃত কোনো আত্মীয়েরই হতে হবে, এমনটিও নয়। অনেকেই এই প্রথা পালনের জন্য খুলি কেনেন অথবা পূর্বসূরিদের থেকে প্রজন্মান্তরে পেয়ে থাকেন। 

ভালপুরগিসের রাত 

জার্মান লোকগাথা অনুযায়ী প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ রাতে দেশটির উত্তরে হার্জ পর্বতমালায় ডাইনিরা একত্রিত হয় নাচের উদ্দেশ্যে। সে রাতে অশুভ শক্তি থেকে বাঁচতে আগে লোকেরা এক জায়গায় জমায়েত হয়ে জোরে চিৎকার করতো, বড় করে আগুন জ্বালাত, অশরীরী হাউন্ডের জন্য বাড়ির বাইরের বাইরে মাখন ও মধু মিশ্রিত রুটি ফেলে রাখত।   

IEDCR-1.jpg

বর্তমানে এর অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এখন ৩০ এপ্রিলকে আর ভয়ের নয়, বরং উদযাপনের রাত বানিয়ে ছেড়েছে সেখানকার অধিবাসীরা। মানুষ বিচিত্র ধরনের সাজপোশাক পরে, আতশবাজিতে আকাশ প্রজ্বলিত করে, লোকগান গেয়ে-নেচে এই রাতটি উদযাপন করে। জার্মানি ছাড়াও নর্ডিক দেশগুলোতে এ রাতের প্রচলন রয়েছে। 

 

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, মেন্টাল ফ্লস, রোভ, সিবিসি কিডজ, দ্যা কালচার ট্রিপ