ব্যবসায়ীদের বিপুল ক্ষতি, বিমা দাবি ৬০০ কোটি ছাড়িয়েছে

সুকান্ত হালদার
সুকান্ত হালদার
18 November 2025, 06:35 AM
UPDATED 18 November 2025, 13:03 PM

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত মাসের অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৬০০ কোটি টাকার বেশি বিমা দাবি জমা পড়েছে। বিমা কোম্পানিগুলো বলছে, এগুলো প্রাথমিক দাবি। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি সাধারণ বিমা কোম্পানির (জীবন বিমা বাদে) কাছে মোট ৬০৮ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকার দাবি জমা পড়েছে। শুধু প্রাইম ইন্স্যুরেন্স এখনো তাদের তথ্য দেয়নি বলে জানান সংগঠনের সচিব মো. ওমর ফারুক।

বিআইএর ফার্স্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট আদিবা রহমান বলেন, এগুলো প্রথম ধাপের দাবি। বিমা নীতিতে বিভিন্ন শর্ত থাকে, তাই যাচাই শেষে ক্ষতির অঙ্ক কিছুটা বদলাতে পারে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) অগ্নিকাণ্ডের পরপরই প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, গত ১৮ অক্টোবর বিমানবন্দরের ওই অগ্নিকাণ্ডে তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৯৭ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়েছে।

একইসময়ে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প খাত-সংশ্লিষ্টরাও জানিয়েছে, কাঁচামাল ধ্বংস হওয়ায় তাদের ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে।

সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিরাপদ সংরক্ষণব্যবস্থা এবং অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তদন্তকারী দল প্রথমে দুটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত করে—তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সংরক্ষিত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির অতিরিক্ত গরম হওয়া এবং বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। তবে তারা অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার সম্ভাবনাকে নাকচ করেছে।

দাবির বিষয়ে যা বলছে বিমা কোম্পানিগুলো

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের সিইও খালেদ মামুন জানান, খাদ্যপণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, সিমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল ও পাওয়ারসহ বিভিন্ন খাতের কোম্পানিগুলো তাদের কাছে বিমা দাবি জানাচ্ছে।

এ পর্যন্ত ১১৩টি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক নথি দিয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তিনি জানান, এগুলো প্রাথমিক হিসাব, সার্ভেয়ারের (ক্ষতি মূল্যায়নকারী কর্মকর্তা) মূল্যায়ন শেষে আসল ক্ষতি নির্ধারিত হবে।

সেনা ইন্স্যুরেন্সের এমডি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামীম বলেন, আগুন লাগার দিন থেকেই দাবি জানানো শুরু হয়। এ পর্যন্ত ১২টি কোম্পানি ৩২টি পলিসির বিপরীতে ১০ কোটি টাকার দাবি দিয়েছে। এর মধ্যে ২১ লাখ টাকা আগেই পরিশোধ করা হয়েছে।

তার মতে, মোট দাবির ৭০ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত, ৫ শতাংশ ওষুধশিল্প এবং প্রায় ২০ শতাংশ জাহাজ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ খাত থেকে এসেছে। আগুনের পরপরই সার্ভেয়াররা ভেতরে ঢুকতে না পারলেও পরে ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি শুরু হয়।

নিটোল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সিইও এস এম মহবুবুল করিম বলেন, এখন পর্যন্ত ছয়টি বিমা কোম্পানি প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে। পণ্য, তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যাল এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়েছেন। তবে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের পরে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের সিইও সৈয়দ সেহাব উল্লাহ আল-মনজুর জানান, তারা তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পসহ বিভিন্ন খাত থেকে দাবি পেয়েছেন। ১২টির বেশি প্রতিষ্ঠান দাবি জানিয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা। পাঁচজন গ্রাহক ইতোমধ্যে সহায়ক নথিও জমা দিয়েছেন। প্রতিটি দাবি যাচাই করে ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এমডি আহমেদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী জানান, তারা এখন পর্যন্ত ৭৪টি দাবি পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪টি দাবি (১৬ কোটি টাকা) পরিশোধযোগ্য বলে চিহ্নিত হয়েছে।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, বিমা কোম্পানিগুলো নির্দেশনা মেনে ক্ষতির তথ্য জমা দিতে শুরু করেছে। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠানের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় তিনি এর বেশি আরও তথ্য দিতে পারছেন না বলে জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, প্রাথমিক দাবির অঙ্ক থেকেই বোঝা যাচ্ছে ক্ষতির পরিধি কত বড়।

তার মতে, বিমা দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়। কারণ পণ্য পুড়লেও কাগজপত্র ও কার্গো ডকুমেন্টেশন অনলাইনে বা নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত থাকে।

তিনি আরও বলেন, ক্ষতির মূল্যায়নে সাধারণত সার্ভেয়ার, অ্যাসেসর এবং অ্যাকচুয়ারি কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে পূর্ণকালীন অ্যাকচুয়ারি মাত্র দুই-তিনজন রয়েছে।