রবীন্দ্রনাথের মোড় ঘোরানো গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্পের জন্য বেশ বিখ্যাত। এর মধ্যে আলাদা করে 'কাবুলিওয়ালা' গল্পটির কথা বিশেষভাবে বলা যায়। অনেক আলোচকই বলেছেন এটি তার অনন্য সৃষ্টি। ১৮৯২ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত এই গল্পটি কেবল পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেনি।
এটি হয়ে উঠেছিল তার সাহিত্যজীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট—ইংরেজি অনুবাদ দ্য মডার্ন রিভিউতে প্রকাশ এবং শেষে ইউরোপীয় পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া—অনেকটা রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্যিক যাত্রার প্রতিরূপ। এতে কবির পাশে ছিলেন স্যার উইলিয়াম রথেনস্টাইন, সিস্টার নিবেদিতা এবং স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর মতো সহচিন্তকরা।
'কাবুলিওয়ালা' থেকে নোবেল পর্যন্ত পথের নির্মাতা
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কিছু সাক্ষাৎ কেবল ব্যক্তিগত নয়, যুগান্তকারী হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্যার উইলিয়াম রথেনস্টাইনের প্রথম সাক্ষাৎ ছিল তেমনই এক মুহূর্ত। প্রখ্যাত ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ও সাংস্কৃতিক চিন্তাবিদ রথেনস্টাইন ১৯১০-এর দশকে কলকাতা সফরে এসে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হন এবং সম্পর্কের এক নতুন দ্বার খুলে দেন।
রথেনস্টাইন স্মৃতিচারণে লেখেন: 'আমি একদিন মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরিত একটি গল্পের অনুবাদে চোখ রাখলাম এবং সেই গল্প আমাকে যেন মন্ত্রমুগ্ধ করল।' উনিশ শতকের শেষের দিকে 'কাবুলিওয়ালা' গল্পটি রচনা করেন এবং এটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা সাময়িকী সাধনা পত্রিকায় (১৮৯২ ইংরেজি) বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যায় অর্থাৎ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার প্রায় ২০ বছর আগে। গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় মডার্ন রিভিউতে। অনুবাদ করেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। অনুবাদের ১২ বছর পর মডার্ন রিভিউতে তা প্রকাশিত হয়।
গল্পটি রথেনস্টাইনের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। তিনি এতটাই গভীরভাবে প্রভাবিত হন যে জোড়াসাঁকোয় চিঠি লিখে আরও রচনার অনুরোধ জানান। ফলস্বরূপ, তার হাতে পৌঁছে যায় অজিত চক্রবর্তী অনূদিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি খাতা। রথেনস্টাইন লেখেন: 'কবিতাগুলো রহস্যময় আধ্যাত্মিক আবেশে ভরা—গল্পটির চেয়েও গভীর ও অনন্যসাধারণ, যদিও অনুবাদগুলো খানিকটা অপরিণত।'
রথেনস্টাইন এই আকর্ষণ থেকেই রবীন্দ্রনাথকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হন কুচবিহার রাজপরিবারের প্রমত্ত লল সেন ও দার্শনিক ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। রথেনস্টাইন স্মৃতিতে লেখেন: 'অবশেষে সংবাদ এলো—রবীন্দ্রনাথ যাত্রাপথে রয়েছেন। তিনি এসে পৌঁছালেন, সঙ্গে ছিলেন তার দুই বন্ধু ও পুত্র। ঘরে প্রবেশ করতেই তিনি আমাকে দিলেন একটি খাতা এবং বললেন—ভারত থেকে যাত্রাপথে তিনি নিজেই কিছু কবিতার অনুবাদ করেছেন, আমি যেন সেগুলো গ্রহণ করি।'
এই ঘটনা 'গীতাঞ্জলি'-র ইংরেজি অনুবাদের জন্ম দেয়, যা ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়ে ইউরোপীয় সাহিত্যসমাজে আলোড়ন তোলে এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে এনে দেয় ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কার। স্পষ্টতই, যদি 'কাবুলিওয়ালা' গল্পটি রথেনস্টাইনের হৃদয় ছুঁয়ে না যেত, তবে হয়তো রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ও ইউরোপে তার গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস অন্যরকম হতো।
'কাবুলিওয়ালা'র প্রথম অনুবাদকারী
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে পশ্চিমে পৌঁছে দেওয়ার এই অভিযাত্রায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম সিস্টার নিবেদিতা। আয়ারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে ভারতে এসে নারীশিক্ষা ও জাতীয় জাগরণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। তারই দেওয়া নাম 'নিবেদিতা'— অর্থাৎ 'যিনি নিজেকে নিবেদন করেছেন'। নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও চিন্তার বিনিময়ের।
রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, নিবেদিতা কেবল 'কাবুলিওয়ালা' নয়, রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি গল্প—'ছুটি' ও 'দান প্রতিদান'—ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলো পরে হারিয়ে যায়।
নিবেদিতার চিঠি থেকে আমরা জানি, তিনি নভেম্বর ১৯০০-তেই এসব অনুবাদ করেছিলেন। নিবেদিতা ১৯০০ সালের ২২ নভেম্বর মিসেস ওলে বুলকে লিখেছেন—'…কাবুলিওয়ালা শেষ করেছি, আজ রাতেই ভূমিকা শেষ করতে হবে।' সাত দিনের মধ্যে আবার লিখলেন—'কাবুলিওয়ালা ও ছুটি দুটোই ইংরেজি হয়ে গেছে, আর দান প্রতিদান প্রায় শেষ।' অনুবাদগুলো বাংলা সাহিত্যের দরজা খুলে দেয় পশ্চিমের পাঠকের সামনে। বিশেষত 'কাবুলিওয়ালা'ই হয়ে ওঠে সেই প্রথম সেতু, যার ওপর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাড়ি দেয় ইউরোপের দিকে।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু: প্রথম প্রচেষ্টার সাক্ষী
এই অভিযাত্রার সূচনালগ্নে আরেক গুরুত্বপূর্ণ নাম স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সহযাত্রী। বসু গভীরভাবে অনুভব করতেন যে পশ্চিম তখনো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক মহত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ১৯০০ সালে হারপার্স ম্যাগাজিনে নিবেদিতার করা 'কাবুলিওয়ালা'-র অনুবাদ পাঠান। গল্পটি প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায় এই বলে যে, 'পশ্চিম তখনো প্রাচ্যের জীবনযাপনের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী নয়।'
যদিও সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, এটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। বসুর এই উদ্যোগই পরোক্ষভাবে পরবর্তীকালের রথেনস্টাইন-নিবেদিতা-সংযোগের জন্য ভূমি প্রস্তুত করে দেয়।
'কাবুলিওয়ালা' কেবল একটি ছোটগল্প নয়, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক ভাগ্যের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। এই গল্পই প্রথমে সিস্টার নিবেদিতার অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমে পৌঁছায়, রথেনস্টাইনের হৃদয় জয় করে তাকে লন্ডনে আহ্বান জানায় এবং অবশেষে 'গীতাঞ্জলি'-র মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে পৌঁছে দেয়।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর প্রাথমিক প্রচেষ্টা, নিবেদিতার অনুবাদ এবং রথেনস্টাইনের অনুপ্রেরণা—এই তিন শক্তিই মিলিতভাবে 'কাবুলিওয়ালা'কে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে বিশ্বের পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়। আর সেই পথ ধরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষার প্রথম এবং একমাত্র নোবেলজয়ী সাহিত্যিক।