দাড়ির পুনর্জাগরণ: নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্রোতের ইঙ্গিত?
আজকাল ক্লিনশেভ মুখ যেন বিরল! রাস্তায়, শপিংমলে কিংবা অফিসে- চারদিকে শ্মশ্রুশোভিত পুরুষের সংখ্যাই বেশি। কেউ রাখছেন হালকা 'ফাইভ ও'ক্লক শ্যাডো', কেউ চিবুকের নিচে অল্প দাড়ি বা সোল প্যাচ, কেউ আবার মুখ ভর্তি ঘন দাড়িতেই আত্মপ্রকাশ করছেন।
একসময় প্রতিদিন সকালে রেজার হাতে ক্লিনশেভ করা ছিল পুরুষদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখন সেই রেজার যেন থেমে গেছে। তাহলে কি আবারও দাড়ি যুগের উত্থান হলো? আর পুরুষের মুখে দাড়ি কবে থেকেই বা এমন 'ফ্যাশন স্টেটমেন্ট' হয়ে উঠল?
নিউইয়র্ক টাইমসে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দাড়ির ট্রেন্ড, ইতিহাস এবং এর অর্থবহ দিক।
দাড়ির চল কখনো থেমে থাকেনি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অন্তত চারবার 'দাড়ির পুনর্জাগরণ' ঘটেছে—দ্বিতীয় শতক, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ এবং উনবিংশ শতকের শেষভাগে। এখন একবিংশ শতকে পঞ্চম দাড়ি-যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব।
ইতিহাসের পাতায় দাড়িওয়ালা মহারথীর সংখ্যা কম নয়। হেনরি অষ্টম, শেক্সপিয়ার, এমনকি মূসাও। ১৭শ শতকের চিত্রশিল্পী অ্যান্থনি ভ্যান ডাইক-এর নামে তো একটি দাড়ির স্টাইলই জন্ম নেয়। ১৯শ শতকে ছিলেন আব্রাহাম লিংকন, কার্ল মার্কস ও চার্লস ডারউইন —সবাই দাড়ি রেখেছিলেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে।
দাড়ি বরাবরই পৌরুষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ১৯৬০ ও '৭০-এর দশকে নতুন মাত্রা পায় দাড়ি। বিদ্রোহ, স্বাধীনতা আর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। 'ফিদেল কাস্ত্রো' বা 'হেয়ার' সিনেমার চরিত্রদের দাড়ি তখন স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে উঠেছিল।
তবে ১৯ শতকে ওয়াল স্ট্রিট ও করপোরেট জগতের উত্থানের পর আবেদন হারায় দাড়ি। তখন দাড়িওয়ালা পুরুষদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো। মনে করা হতো দাড়ির আড়ালে কিছু গোপন করছে। সেসময় দাড়ি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় শিল্পী, দার্শনিক, অধ্যাপক, বৃদ্ধ বা আদিবাসীদের মধ্যে।
এখন আবার সেই চিত্র উল্টো গেছে। দাড়ি ফিরেছে রঙিন ভঙ্গিতে, আরও শক্তিশালী রূপে। বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে দৃঢ় হচ্ছে দাড়ির ছাপ।
৩৪ বছর বয়সী মিলেনিয়াল প্রজন্মের প্রতিনিধি নিউইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সুন্দর করে ছাঁটা, পরিচ্ছন্ন করপোরেট দাড়ি এখন রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দেওয়ার অঙ্গীকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
প্রায় ১০০ বছর পর প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কের দাড়িশোভিত মেয়র হচ্ছেন মামদানি। ২০১৩ সালে কলেজের সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখা 'বিয়ার্ডেড ইন কায়রো' শিরোনাম প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, বাদামি গায়ের রঙ আর দাড়ি মানে সন্ত্রাসী—দেশে প্রচলিত এমন ধারণার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাতেই দাড়ি রেখেছেন তিনি।
ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, টেড ক্রুজসহ ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য রাজনীতিতে হাজির হয়েছেন দাড়ি নিয়ে।
বিখ্যাত পেশাদার বেসবল খেলোয়াড়দের দল নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিস তাদের ৫০ বছরের 'ক্লিনশেভ নীতি' বদলে দিয়েছে, অনুমতি দিয়েছে পরিপাটি দাড়ি রাখার। ডিজনি, যারা ১৯৫০ সাল থেকে কর্মীদের দাড়ি নিষিদ্ধ করেছিল, ২০১২ সালে সেই নিয়ম বাতিল করে।
বিগত সময়ে অন্তত পঞ্চাশ বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে সমাজে গ্রহণযোগ্য ও প্রভাবশালী চেহারা ছিলেন ক্লিনশেভ পুরুষরা। কিন্তু, দাড়ির পুনরুত্থান নতুন সাংস্কৃতিক স্রোতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধু ফ্যাশন নয়, দাড়ি এখন পৌরুষের প্রতীক, টেস্টোস্টেরনের দৃশ্যমান প্রকাশ।
ব্যক্তি স্বাধীনতা, পরিচয় ও 'ম্যানোস্ফিয়ার'— এর রাজনৈতিক প্রকাশের স্বীকৃত রূপ এখন দাড়ি।
তবে, ফ্যাশন টেন্ড্রে যখন সবাই দাড়ি রাখে, তখন দাড়ির আর আলাদা মূল্য থাকে না। ফ্যাশন সাংবাদিক জ্যাকব গ্যালাগার বলেন, 'যখন সব পুরুষই দাড়ি রাখেন, তখন সেটা আর পৌরুষের প্রতীক নয়—বরং হয়ে যায় ক্লিশে।' ইতিহাসও তাই বলে—যখন কোনো ট্রেন্ড অতিরিক্ত জনপ্রিয় হয়, তখনই ফ্যাশন ঘুরে দাঁড়ায় বিপরীত দিকে।
তাই প্রশ্ন রয়ে যায়—রেজার কি আবার ফিরবে পুরুষদের প্রতিদিনের রুটিনে? সম্ভবত হ্যাঁ। কারণ ফ্যাশনের জগতে একটাই নিয়ম চিরকাল সত্যি—যা যায়, তা আবার ফিরে আসে।

