যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদ কার নিয়ন্ত্রণে
পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে ক্ষমতার টানাপড়েন থেকে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল গৃহযুদ্ধ শুরু হয় । তিন বছরে গড়াচ্ছে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত। দেশটির সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) মধ্যে চলে আসছে ক্ষমতা দখলের এই লড়াই।
সুদানে গৃহযুদ্ধের ফলে ঘরছাড়া হয়েছেন দেশটির ১৮ রাজ্যের প্রায় ৯৫ লাখ বাসিন্দা। না খেয়ে থাকতে হচ্ছে লাখো মানুষকে।
প্রাকৃতিক সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ সুদান। আছে তেল, স্বর্ণ ও কৃষিসম্পদ। ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে ১৯৫ দেশের মধ্যে ৬৫তম অবস্থানে ছিল তারা।
এ দিয়েই আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন সুদানের নাগরিকরা। তবে গৃহযুদ্ধ ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বদল হওয়ায় তা হতে পারছে না।
তাহলে সুদানের এসব সম্পদ এখন কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন?
কার দখলে কী পরিমাণ সম্পদ
সুদানের উত্তর ও পূর্ব দিকের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। এর মধ্যে আছে রাজধানী খার্তুমসহ নীলনদ সংলগ্ন এলাকাগুলো। লোহিত সাগরে বন্দরনগরী পোর্ট সুদানের নিয়ন্ত্রণও সেনাদের হাতে।
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আরএসএফ-এর হাতে। গত ২৬ অক্টোবর এল-ফাশের দখলের মধ্য দিয়ে দারফুরে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে আরএসএফ।
প্রধান রপ্তানি পণ্য
সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুসারে—প্রায় ১৮ লাখ ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুদান আফ্রিকার তৃতীয় ও বিশ্বের ১৫তম বড় দেশ। ২০২৪ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি ৫ লাখ।
সুদানের প্রধানতম রপ্তানি পণ্য মূলত তিনটি। তেল, স্বর্ণ ও কৃষিপণ্য। ২০২৩ সালে ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে সুদান। স্বর্ণ রপ্তানি করে ১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারের।
এ ছাড়াও, ৯০১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের প্রাণিসম্পদ, ৭০৯ মিলিয়ন ডলারের তেলবীজ, ৪৩৭ মিলিয়ন ডলারের চিনাবাদাম ও ১৪১ মিলিয়ন ডলারের অ্যারাবিক গাম রপ্তানি করে সুদান।
কৃষি ও প্রাণিসম্পদ
দ্য অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) প্রতিবেদন বলছে—২০২৩ সালে দেড় বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে সুদান। এ ছাড়াও, পশু রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয় ৯০১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার।
তেলবীজ, ভেড়া-ছাগল, ও বাদামের খৈল রপ্তানিতে বিশ্বের শীর্ষ দেশ সুদান। তিল ও অ্যারাবিক গাম উৎপাদনেও বিশ্বের শীর্ষে আছে তারা।
সুদানের প্রায় ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ জমি কৃষিকাজ ও চারণ উপযোগী। নীল নদের কল্যাণে বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে পানি বা সেচের অভাব হয় না।
দুই পক্ষের দখলেই আছে এমন উর্বরভূমি। উত্তর দিকে অ্যারাবিক গাম হয় যে অংশে, তার নিয়ন্ত্রণ আরএসএফের হাতে। এ ছাড়াও, প্রধান শস্যগুলো উৎপাদিত হয় সেনা নিয়ন্ত্রিত অংশে।
তেল
২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সুদানের প্রায় ৭৫ শতাংশ তেল উত্তোলন কমে যায়। এর আগে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দৈনিক ২ লাখ থেকে ৫ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উত্তোলিত হতো সুদানে। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা কমে হয় ৭০ হাজার ব্যারেল। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।
সুদান বিশ্বের ৪০তম বৃহৎ অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক। দেশটির অধিকাংশ তেলক্ষেত্রই দক্ষিণে ও প্রতিবেশী দক্ষিণ সুদানের সীমান্ত লাগোয়া এলাকায়। এর অধিকাংশই বর্তমানে আরএসএফের দখলে। তবে বেশিরভাগ শোধনাগার সেনা নিয়ন্ত্রিত অংশে।
সুদানে তেল শোধনাগার আছে পাঁচটি। এর মধ্যে দৈনিক ১ লাখ ব্যারেল সক্ষমতার সবচেয়ে বড় শোধনাগারটি খার্তুমে। এটি আগে আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখন সেনাবাহিনীর দখলে। এ ছাড়া, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে তেল রপ্তানির দুটি টার্মিনালও।
সুদানের দক্ষিণের ওই অংশ থেকে উত্তোলিত অপরিশোধিত তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে উত্তরে আসে। বাশায়ের ও পোর্ট সুদান টার্মিনাল দিয়েই এসব তেল রপ্তানি হয়। এমনকি, দক্ষিণ সুদানও এই দুই টার্মিনাল ব্যবহার করে।
স্বর্ণ
গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই স্বর্ণ খনি ও বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ দুই পক্ষের অর্থায়নে বড় ভূমিকা রেখে আসছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর স্বর্ণখনির নিয়ন্ত্রণ বাহিনী দুটোর হাতে।
সংবাদমাধ্যম সুদান ট্রিবিউনের তথ্য অনুসারে, যুদ্ধপরিস্থিতিতেও ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে স্বর্ণ উত্তোলনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। গত বছর প্রায় ৬৪ টন স্বর্ণ উত্তোলিত হয় দেশটিতে।
২০২৩ সালে ১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার স্বর্ণ রপ্তানি করলেও পরের বছর তা বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে অবৈধভাবেও স্বর্ণ রপ্তানি হয়। ওইসি জানায়, ২০২৩ সালে দেশটির রপ্তানিকৃত স্বর্ণের ৯৯ শতাংশের ক্রেতা ছিল আরব আমিরাত।
সুদানের বাণিজ্য সহযোগী কারা
সুদানের মোট রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশের বাজার এশিয়া। এর বাইরে ইউরোপে ১১ শতাংশ ও আফ্রিকায় সাড়ে ৮ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করে দেশটি। আরব আমিরাত (২১ শতাংশ), চীন (১৭ শতাংশ), সৌদি আরব (১৬ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৯ শতাংশ) ও মিশর (৭ দশমিক ৬ শতাংশ)—সুদানের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি রপ্তানি আয় এনে দেয় এই পাঁচ দেশ।
দেশটির তেল রপ্তানির অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও, স্বর্ণ রপ্তানির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে আরএসএফ। বৈধ পথের পাশাপাশি চোরাচালান হয়ে মোট স্বর্ণের অনেকটা অংশ। ইতালিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজের তথ্য মতে, এর পরিমাণ মোট স্বর্ণের ৫০ থেকে ৮০ ভাগ।
আরএসএফ প্রধান মোহামেদ হামদান দাগালোর প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: আল গুনাদে) এটি নিয়ন্ত্রণ করে। লিবিয়া, চাদ ও দক্ষিণ সুদান হয়ে যা পৌঁছে যায় আরব আমিরাতে।
গৃহযুদ্ধ সুদানের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে করেছে ধ্বংস। এই লড়াই কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষগুলোর একটিকে সৃষ্টি করেছে। জেনোসাইড ওয়াচের তথ্য অনুসারে, প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষকে হতে হয়েছে তীব্র ক্ষুধা বা অনাহারের মুখোমুখি।
কিন্তু, সুদানে স্বর্ণ ব্যবসা জমজমাট। বিশাল এই দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সমৃদ্ধ স্বর্ণখনি থেকে উৎপাদন ও বাণিজ্য যুদ্ধপূর্ব স্তরকেও ছাড়িয়ে গেছে। যখন স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন সুদান থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ চারদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু, এই সম্পদ ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন লাখো মানুষের কাজে আসছে না। এটি রসদ যোগাচ্ছে যুদ্ধরত দুই পক্ষকে। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, পক্ষ দুটি কোটি মানুষের বিরুদ্ধে 'অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে' ব্যবহার করছে।