সংগীতে বিপ্লবের দিশা দেখানো এক স্বপ্নবাজ বিদ্রোহী

মাহমুদ নেওয়াজ জয়
মাহমুদ নেওয়াজ জয়
8 December 2025, 11:37 AM
UPDATED 8 December 2025, 19:09 PM
তিনি শুধুই একজন গায়ক নন, বরং বিদ্রোহের মুখ হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৬০-এর দশকের পৃথিবী ছিল পরিবর্তনের ক্ষুধায় কাতর—একদিকে স্নায়ুযুদ্ধ, অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুবসমাজের বিস্ফোরণ। নারীর অধিকার, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার, স্বাধীনতার দাবি—সব কিছুর এক উত্তাল মিলন ঘটেছিল সেই সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। আর সে সময়েই লিভারপুলের এক অগোছালো, বিদ্রোহী ছেলে গিটার হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন সর্বব্যাপী প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে।

সেই ছেলেটির নাম—জন উইনস্টন লেনন। তিনি শুধু সংগীতশিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন সময়ের ভাষা, সময়ের প্রশ্ন, সময়ের প্রতিবাদের প্রতীক। আর সেই কারণেই তিনি সেই সময়কার যুবসমাজের কাছে শুধুই এক গায়ক নন, বরং বিদ্রোহের মুখ হয়ে উঠেছিলেন।

স্কুলের বেঞ্চ থেকে বিদ্রোহের শুরু

লেননের শিশুবয়স ছিল নানা ভাঙাচোরা অভিজ্ঞতার ভিড়ে তৈরি। খুব ছোটবেলায় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ এবং লালন-পালনের দায়িত্ব নানা-নানুর ওপর চলে যাওয়া তাকে অস্থির আর রাগি করে তোলে। স্কুলে পড়াশোনায় তিনি কখনোই মন বসাতে পারেননি। শিক্ষকরা তাকে ধমক দিয়ে বলতেন—'তোমার মাথায় শুধু দুষ্টুমি আর বেয়াড়া ভাব'। অথচ সেই বেয়াড়াভাবই তাকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। প্রথার বাইরে ভাবার অভ্যাস তার কৈশোরেই তৈরি।

লিভারপুলের রাস্তায় ঘোরাফেরা, স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করা এবং সংগীতের প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ—এসব মিলে তার জীবন হয়ে ওঠে বিদ্রোহের প্রাথমিক পাঠশালা। এই বিদ্রোহ কোনো ধ্বংসাত্মক আগুন ছিল না; বরং ছিল এক সৃষ্টিশীল আগুন, যা পরবর্তীকালে অসংখ্য মানুষের অন্তরের আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে।

বিটলম্যানিয়া: বিনোদনের ছদ্মবেশে সামাজিক পরিবর্তন

লেননের নেতৃত্বে একদল নতুন ছেলের গড়া গানের দল 'দ্য বিটলস'—তাদের গানের শক্তিতে বদলে দিলো সংগীতের সংজ্ঞা। সুমধুর সুর, আকর্ষণীয় কথা আর মঞ্চে চারজনের বেপরোয়া প্রাণশক্তি—সারা পৃথিবীকে নাচিয়ে তুললো। তবে জন লেনন শুধু নাচানোর জন্য গান করেননি। তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন—পৃথিবী অস্থির, অসহ্য অবিচারে ভরা। তাই যুদ্ধ অনিবার্য।

'অল ইউ নিড ইজ লাভ'—এ গান ছিল তারুণ্যের অস্ত্র। এতে ভালোবাসার ওপরে দাঁড়িয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল। আবার 'রেভল্যুশন' গানে তিনি অতি-উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলনের সমালোচনা করেন; দেখিয়ে দেন পরিবর্তন মানে শুধু ধ্বংস নয়, বরং মানবিক সচেতনতা। গানগুলো তারুণ্যের হাতে তুলে দেয় নিজেদের অবস্থান জানানোর ভাষা।

বিটলম্যানিয়ার উত্তাপে পৃথিবী যখন শুধু আমোদেই মশগুল, তখন লেনন সেই উচ্ছ্বাসকে ব্যবহার করলেন নতুন চিন্তার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। তিনি খ্যাতিকে করলেন অস্ত্র, আর শ্রোতাদের করলেন তার রাজনৈতিক দর্শনের সহযোদ্ধা।

ইমেজ ভাঙার সাহস

লেননের পোশাক-পরিচ্ছদ, কথা বলার ধরন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর নিয়ম—সবকিছুই ছিল প্রচলিত নিয়ম ভাঙার ঘোষণাপত্র। তার গোল ফ্রেমের চশমা, ঢিলেঢালা সামরিক জ্যাকেট, ভাঙাচোরা স্টাইলিশ ভাব—সবই ছিল সেই বার্তা বহনকারী: 'আমি তোমাদের বানানো নিখুঁত শ্রেণিতে ঢুকবো না'।

সেই সময়ের বিনোদন শিল্পের শিল্পীদের আপাত হাসিখুশি, নীরবতাপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান পালনকেই স্বাভাবিকতা বলা যায়। কিন্তু লেনন কণ্ঠ তুলে বললেন—'শিল্পীর নীরবতা অপরাধ'। তিনি ব্যঙ্গ করলেন ক্ষমতাকে, প্রশ্ন তুললেন যৌনতা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ট্যাবুগুলোতে। তার ফ্যাশনও ছিল 'স্ট্যাটাস-কো' ভাঙার যুদ্ধ—পুরুষত্বের কঠোর মুখোশের বদলে তিনি কোমলতা, সংবেদনশীলতা গ্রহণ করলেন।

তিনি দেখালেন—ফ্যাশনও পারে বিদ্রোহের ভাষা হতে।

ইয়োকো ওনো: ভালোবাসার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র

ইয়োকো ওনোর সঙ্গে পরিচয় তার শিল্পীজীবনে যে বদল এনেছে, তা কেবল প্রেমের নয়, দৃষ্টিভঙ্গিরও। ইয়োকো তাকে শিখিয়েছিলেন—শিল্পের প্রকৃত শক্তি দর্শকের ভাবনাকে নাড়িয়ে দিতে।

বিয়ের পর তাদের 'বেড-ইন ফর পিস' গানে হোটেলের বিছানায় বসে থাকা, সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ—এ যেন ভীষণ ব্যতিক্রমী এক প্রতিবাদ। তারা বুঝেছিলেন মনোযোগই পরিবর্তনের প্রথম পথ। মানুষ প্রথমে হাসলো, কিন্তু এই  বার্তা ঠেকানো গেল না—যুদ্ধ নয়, ভালোবাসাই হবে সমাজ বদলের শক্তি।

এমনকি যখন তাদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠলো, যখন বলা হলো তারা কেবল নাটক করছে—তবুও লেনন পিছিয়ে যাননি। কারণ তিনি জানতেন, সাহসী কণ্ঠ কখনোই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কিন্তু তা থাকাটা সবসময়ই জরুরি।

রাজনীতির ময়দানে সরাসরি প্রবেশ

ভিয়েতনাম যুদ্ধ লেননকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। আমেরিকায় লাখো মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমে পড়েছে। আর তাদের আন্দোলনের সংগীতে লেননের গান পুরোপুরি জায়গা করে নিলো। 'গিভ পিস অ্যা চান্স' হয়ে উঠলো সেই আন্দোলনের জাতীয় সংগীত।

এই পর্যায়ে লেননের জনপ্রিয়তা তাকে সরকারের চোখে পরিণত করলো বিপজ্জনক এক শক্তি হিসেবে। এফবিআই তাকে নজরে রাখে। তার আমেরিকা থাকার অনুমতিও বাতিলের চেষ্টা চলে। রাষ্ট্রের এই প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে—একজন শিল্পীর কণ্ঠ যদি সত্যিকারের শক্তিশালী হয়, তবে ক্ষমতার প্রাসাদ কেঁপে ওঠে।

লেনন নিজেই বলেছিলেন, 'আমি গুলি নয়, গিটার দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাই'। তার এই কথা শুধু স্লোগান ছিল না—এটি ছিল রাষ্ট্রবিরোধী মানবতার ঘোষণা।

আইকনিক নান্দনিকতা: শিল্প, স্টাইল, আর ব্যঙ্গ

জন লেননের শিল্প ছিল বহুমাত্রিক। তিনি নিজের জনপ্রিয়তাকেও ব্যবহার করতেন মানুষের আধুনিক ভ্রান্তি তুলে ধরতে। একদিকে ছিল তার ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস, অন্যদিকে মানবিকতার চরম অনুভব। 'ইমাজিন' গানটি এই দুইয়ের এক মহাজাগতিক মিশ্রণ।

সাদা পোশাক, সাদা ঘর, সাদা পিয়ানো—সবকিছু মিলিয়ে যে শূন্যকরণ দরকার ছিল পৃথিবীর বিদ্বেষ, জাতি-ধর্ম-সম্পত্তিগত বিভাজনগুলো দূর করার জন্য, সেই ধারণাটিই তিনি তুলে ধরলেন। গানটি আজও মানবতার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

লেনন শিখিয়েছেন—একজন শিল্পী শুধু সুর সৃষ্টিকারী নয়; সে মানুষের মননেও বিপ্লব ঘটাতে পারে।

নিউইয়র্ক: নতুন ঘর, নতুন আন্দোলন

বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর লেনন চলে যান নিউইয়র্কে। সেখানে তিনি আরও কাছ থেকে দেখলেন জনগণের সংগ্রাম। শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মিশে, রাস্তার শিল্পী ও কবিদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তার সুর হয়ে উঠল আরও প্রাঞ্জল, আরও বাস্তব।

এই সময়েই তিনি নিজের শিল্পকে শিল্পগ্যালারি থেকে রাস্তায় নিয়ে আসেন। তার গানে উঠে আসে শহরের হাহাকার, মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, স্বাধীনতার আর্তি। নিউইয়র্কই তাকে 'আইকন' থেকে 'জনতার কণ্ঠ' করে তুলেছিল।

লেননের আগুন: না নেভা উত্তরাধিকার

১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের ডাকার ভবনের সামনে এক উন্মাদ ভক্তের গুলিতে জীবনের ইতি টানলেন জন লেনন। মাত্র ৪০ বছর বয়স হয়েছিল তার। পৃথিবী থমকে গেল। লাখো মানুষ কাঁদলো—কারণ তারা হারালো শুধু এক শিল্পীকেই নয়, বরং হারালো একজন দিশা দেখানো বন্ধু, একজন রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধকারী দার্শনিক, একজন স্বপ্নবাজ বিদ্রোহীকে।

লেনন প্রমাণ করে গেছেন—বিদ্রোহ মানে কেবল প্রতিরোধ নয়, বিদ্রোহ মানে মানবিকতার পাশে দাঁড়ানো। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বারবার বলেছে—শিল্প ক্ষমতার সেবক নয়; শিল্প মানুষের জন্য। তাই আজও যখন কোনো তরুণ তার মনের আগুন নিয়ে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তখন জন লেননের নাম শুনতে পাওয়া যায় সুরের ভেতর ভেসে—'ইউ মে সে আই অ্যাম অ্যা ড্রিমার...'

লেনন স্বপ্ন দেখেছিলেন মানবতার পৃথিবীর। আর আজও সেই স্বপ্ন নতুন শতাব্দীর প্রতিটি প্রতিরোধে গেয়ে ওঠে—'ইমাজিন অল দ্য পিপল লিভিং লাইফ ইন পিস...'