হিংসা আর বিদ্বেষে ভরা অভিশপ্ত এক রাত
শান্তির ডাক দিয়ে শুধুমাত্র পিয়ানো বাজিয়ে গাওয়া 'ইমাজিন' গানটি যারা শুনেছেন, বুঝেছেন কিংবা বুঝতে চেষ্টা করেছেন তারাই প্রেমে পড়েছেন জন লেননের।
বিশ শতকের ষাটের দশকে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে আবির্ভাব হওয়া তর্ক সাপেক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড 'দ্য বিটলসের' অন্যতম প্রধান সদস্য জন লেনন।
লেনন এমন একজন যিনি শান্তির ডাকে লিখেছেন, 'এমন একটি পৃথিবী যদি হতো, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, নেই ক্ষুধা বা দারিদ্র্য, নেই মানুষের মধ্যে বিভেদ। এমনকি নেই কোনো দোজখ বা বেহেশত।'
বিনিময়ে মানুষের ভালোবাসার সঙ্গে জুটেছে হিংসার ক্রুশে মৃত্যু।
হিংসা-বিদ্বেষের ফলাফল
লেননের গোটা ৪০ বছরের জীবনকে যদি একটা সিনেমা বা উপন্যাস ধরা হয়, তবে সেই গল্পের নায়ক লেনন হলে, হার্ডকোর ভিলেন হিসেবে নাম থাকবে কুখ্যাত ঠাণ্ডা মাথার সাইকিক খুনি মার্ক চ্যাপমানের।
অপরাধবিজ্ঞানের মনস্তত্ত্বে এখনো অপরিষ্কার অধ্যায় হয়ে আছেন মার্ক চ্যাপম্যান।
১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে নিজের অ্যালবাম 'ডাবল ফ্যান্টাসির' প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জন উইন্সটন লেনন।
সেদিন ছিল ৮ ডিসেম্বর। সস্ত্রীক নিউইয়র্কের বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন স্টুডিওতে। অন্য সব দিনের মতো সেদিনও বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একদল ভক্ত এসে জড়ো হয়েছিল বাসার সামনে। একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গিয়েছিল বলা যেতে পারে।
সেই ভিড় ঠেলে চ্যাপম্যান এগিয়ে গিয়ে 'ডাবল ফ্যান্টাসির' একটা রেকর্ডে অটোগ্রাফ নিলেন। লেনন সই করে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ইজ দিস অল ইউ ওয়ান্ট?' উত্তরে মুচকি হেসে নির্বাক ছিলেন চ্যাপম্যান।
তারপর গাড়িতে করে স্টুডিওর দিকে চলে যান লেনন।
কিছুক্ষণ পর কাজ সেরে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন লেনন ও তার স্ত্রী ইয়োকা ওনো। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়ির দরজার দিকে। ততক্ষণে চ্যাপম্যান পাশের গলি থেকে বের হয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলেন লেননকে পেছনে ফেলে।
কিন্তু তাকে পেছনে ফেলে লেনন আর ওনো এগিয়ে গেলেন আরেকবার। ঠিক সেই মুহূর্তেই চ্যাপম্যন ডাকলেন 'হেই, জন লেনন'।
পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধ সেই রাত কাঁপিয়ে শোনা গেল গুলির আওয়াজ। একবার নয়, পরপর পাঁচবার।
তার মধ্যে একটা গুলি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও বাকি চারটা বিধেছিল বুকে। নিকটস্থ রুজভেল্ট হসপিটালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
লেননকে গুলি করার পরে তারই বাসভবন ডাকোটা বিল্ডিংয়ের অপর পাশের রাস্তায় নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে জে ডি স্যালিঙ্গারের 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই' উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেন চ্যাপম্যান।
পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তুমি কি জানো, তুমি কী করেছো? তখন চ্যাপম্যান উত্তরে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, আমি এইমাত্র জন লেননকে গুলি করে হত্যা করেছি।'
কথাটি বলার সময় একদম নির্বিকার ছিলেন চ্যাপম্যান।
'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই' বইয়ের প্রথম পাতায় লেননকে হত্যার কারণ হিসেবে চ্যাপম্যান লিখে রেখেছিলেন—'বিশ্বাস ও নীতিগত বিদ্বেষ'।
বিদ্বেষের সূত্রপাত যেখানে
চ্যাপম্যানের প্রথম জীবন ছিল ভয়াবহ, যার রেশ তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন। ১৪ বছর বয়সে শুরু করেন মাদকের নেশা। বুলিংয়ের শিকার হতেন বলে স্কুলেও যেতেন না নিয়মিত।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকতেন যে-সে রাস্তায়। এর মাঝে এই জীবন থেকে সস্তি খুঁজতে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের আশ্রয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায়। সেখানেই তার সাহিত্য, কবিতা ও গানের চর্চার শুরু হয়।
'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই' উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে আরও বেশি উগ্রবাদী হয়ে যান তিনি।
একইভাবে তার ওপর প্রভাব ফেলেছে দ্য বিটলস ও জন লেনন। ভক্ত থেকে এক পর্যায়ে হয়ে উঠেছিলেন 'বিটলস'-এর অন্ধভক্ত।
মাত্রাতিরিক্ত নেশা করার পর তিনি বলতেন, 'আমিই জন লেনন'।
বিটলস বরাবরই জনপ্রিয়তার কারণে পত্রিকার শিরোনামে থাকত সবসময়।
১৯৬৬ সালে একটি ব্রিটিশ গণমাধ্যমে রসিকতা করে জন লেনন বলে বসেন, 'বিটলস তো এখন জেসাসের চেয়েও জনপ্রিয়।'
এই একটি বাক্যই ১৪ বছর পর লেননের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। এই বাক্যই খেপিয়ে তোলে 'মৌলবাদী' চ্যাপম্যানকে।
তার এক বন্ধুর আলাদতে দেওয়া জবানিতে জানা যায়, চ্যাপম্যান মাঝেমধ্যে গুনগুন করে গাইতেন জনের সুরেই, 'ইমাজিন ইফ জন ওয়্যার ডেড!'
চ্যাপম্যান বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, জনের মৃত্যুর দায়ভার ঈশ্বর তাকেই দিয়েছেন। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন। আর ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর পেয়ে যান সুযোগ।
আদালতে কয়েকজন আইনজীবী তার মানসিক বিকারগ্রস্ততার কথা বলে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ মুক্তির কথা জানালেও চ্যাপম্যান জানান, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় জেনে-বুঝে জন লেননকে হত্যা করেছেন।
তিনি এও বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছেন।
চ্যাপম্যান নিজে কখনো অনুশোচনায় না ভুগলেও ধ্বংস করেছেন বিশ্ব সংগীতের একটি ধারা।
সেই থেকে মার্কিন কারাগারে বন্দি চ্যাপম্যান। ২০০০, ২০০৪, ২০০৭ সালসহ কয়েকবার প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলেও জননিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়নি তাকে।
লেননের স্ত্রী ইয়োকা ওনোও আবেদন করেছেন চ্যাপম্যানকে যেন কোনো অবস্থাতেই প্যারলে মুক্তি না দেওয়া হয়।
অমর হয়েছেন জন লেনন
জন লেননের অকাল মৃত্যুতেও থেমে যায়নি তার প্রচার করা শান্তির বাণী। এখনো হাজারো মানুষ তার 'ইমাজিন'-এর সুরে স্বপ্ন দেখেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে দেওয়ালের গ্রাফিতি, মুঠোফোনে গান, চিন্তা, মনন আর এরকম হাজার ফিচারে বেঁচে থাকবেন লেনন। শরীরের মৃত্যুতেও মৃত্যু ঘটবে না প্রতিভার, মৃত্যু ঘটবে না শান্তির গীতিকবিতার।