নদীভাঙনের চ্যালেঞ্জ থেকে অনন্য উদ্যোগ: শৈল্পিক ‘কাঠের ঘর’
কেউ ঠিক জানেন না এই ধারণা প্রথম কার কাছ থেকে এসেছিল। স্থানীয়দের ধারণা, এটি এসেছে পদ্মার তীরের জীবনধারা থেকে, যেখানে প্রমত্তা নদী প্রায়ই জমি এবং ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যায়। তখন হয়তো কেউ ভেবেছিলেন—'যদি ঘরটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো যেত?'
এই ভাবনা লৌহজং উপজেলায় এক শিল্পের জন্ম দিয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে সেখানকার কাঠমিস্ত্রিরা তৈরি করছেন রেডিমেড হাউস বা তৈরি ঘর, যা ক্রেতার ইচ্ছামতো যেকোনো জায়গায় পৌঁছে দেওয়া করা যায়।
এখন প্রায় ১০০ ব্যবসায়ী এই উপজেলায় কাজ করছেন। সেখানে 'ঘরদোর বাজার' এখন স্থানান্তরযোগ্য এসব কাঠের ঘরের জন্য সবচেয়ে পরিচিত কেন্দ্র। বাজারের প্রতিটি দোকান প্রতি মাসে দুই থেকে পাঁচটি ঘর বিক্রি করে।
ঝামেলাহীন কাঠের ঘর
কাঠের ঘরগুলো আকর্ষণীয় তাদের জন্য, যারা নির্মাণের ঝামেলা এড়াতে চান, সরঞ্জাম কেনা, রাজমিস্ত্রির তদারকি বা অপ্রত্যাশিত খরচ নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না।
পর্যটন উদ্যোক্তা, খামার মালিক এবং রিসোর্ট মালিকরা এসব ঘরের মূল ক্রেতা। তারা এগুলো ব্যবহার করেন কটেজ, অতিথি কক্ষের জন্য। এসব ঘরের দাম ইট-সিমেন্টের ঘরের তুলনায় কম এবং দেখতেও বেশ মনোরম।
গত মাসে এই প্রতিবেদক ওই এলাকায় গিয়ে দেখতে পান, একটি ঘর ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এর গন্তব্য মানিকগঞ্জে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. আহাদুল্লাহ নামে সম্ভাব্য এক ক্রেতা। তিনি ১০ লাখ টাকার বাজেটের মধ্যে পছন্দের ঘর খুঁজছিলেন।
আহাদুল্লাহ বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করেছি নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে আমাদের খামারের জমিতে ঘর বানাব, যেন ছুটির সময়ে গিয়ে সেখানে থাকতে পারি। ইটের ঘর হলে খরচ ও ঝামেলা অনেক বেশি হতো। এ ছাড়া খরচ সবসময় প্রাথমিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, 'এই কাঠের ঘরগুলো দেখতে সুন্দর এবং দামও যুক্তিসঙ্গত। ছুটি কাটানোর জন্য একদম উপযুক্ত। এক ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুভব হয়।'
এই রেডিমেড কাঠের ঘরগুলোর দাম দুই লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত, যা নির্ভর করে আকার, কাঠের মান, ঘরের পুরুত্ব, নকশা এবং অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার ওপর। সাধারণত চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার ঘরগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়।
আমদানি করা আয়রনউড দিয়ে তৈরি ঘর দাম বেশি হলেও এগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছর টিকে থাকতে পারে। স্থানীয় কাঠে নির্মিত ঘর সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর স্থায়ী হয়।
নকশার ধরন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। ছোট একতলা থেকে শুরু করে ডুপ্লেক্স ধাঁচের ঘর পর্যন্তও তৈরি করেন মিস্ত্রিরা। কিছু ঘরে বারান্দা, অ্যাটাচড বাথরুম বা রান্নাঘরও থাকে। পছন্দসই নকশার সুবিধাও রয়েছে, যা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি করা যায়।
কাঠের ঘরের পেছনের কারিগর যারা
প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কয়েকটি কাঠমিস্ত্রির দল থাকে। সাধারণত প্রতি দলে তিন থেকে ছয়জন শ্রমিক থাকেন। নকশার ওপর নির্ভর করে একেকটি ঘর বানাতে তাদের ১৫ থেকে ২৫ দিন লাগে। প্রতিটি ঘর থেকে তারা আয় করেন ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত মাসিক আয় দক্ষতা ও কাজের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
শহিদ মিয়া একজন কাঠমিস্ত্রি। তিনি বলেন, 'আমি গত ৩৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। শুরুতে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতাম, এখন চুক্তিভিত্তিক কাজ করি।'
কাজটি শ্রমসাধ্য হলেও আধুনিক সরঞ্জাম যেমন ড্রিল, রাউটার ও জিগসোর কারণে এখন দ্রুত এবং নির্ভূলভাবে কাজ করা যায়। শহিদ মিয়া বলেন, 'এখন কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।'
এ শিল্পের খ্যাতি কাছাকাছি জেলা থেকে দক্ষ কাঠমিস্ত্রিদেরও টানছে। কিছু শ্রমিক, যেমন নারায়ণ মধু গোপালগঞ্জ থেকে স্থায়ীভাবে এখানে চলে এসেছেন চাকরির প্রস্তাব পেয়ে।
তিনি বলেন, 'মানুষ আসে, কারণ তারা দেখে অন্যরা কম দামে কিন্তু সুন্দর নকশার ঘর কিনছে। তাই আমরা প্রতিটি ঘর আরও ভালো করার চেষ্টা করি।'
মো. সাজ্জাদ হোসাইন বেগ একজন দোকানমালিক। তার পরিবার ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে কাঠের ঘর তৈরির এই ব্যবসায় যুক্ত। তিনি বলেন, তার দাদা এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পুরনো দিনে কাঠমিস্ত্রিরা ঘর বানাতেন ক্রেতার জমিতে, বিশেষ করে যারা নদীভাঙনের সমস্যায় পড়তেন। 'এখন ঘরগুলোই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে।'
বেগ বলেন, 'এটি এমন ব্যবসা নয়, যেখানে প্রতিদিন বিক্রি হবে। মাসে চার বা পাঁচটি ঘর বিক্রি হলেই আমরা সন্তুষ্ট।'
গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমের প্রচারণা এই শিল্পকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। অনন্য এই ধারণা নজর কাড়ছে, এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটররা প্রায়শই তাদের ভিডিওতে এটি তুলে ধরছেন।
ব্যবসায়ী বেগ বলেন, 'প্রচারণা ও ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতাদের কারণে দেশের মানুষ এখন মানুষ জানে, কম দামে এই ধরনের ঘর কেনা যায়। তাই এখন ঘরগুলো ট্রাক বা ট্রলারে প্রায় প্রতিটি জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে।'
সরদার এন্টারপ্রাইজের মালিক সাকিব সরদার বলেন, 'রেডিমেড ঘরের বিক্রি মূলত গত এক দশক ধরে শুরু হয়েছে, এবং গত পাঁচ বছরে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।'
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী আব্দুর রব জানান, কয়েক দশক আগে তারা ব্যবহৃত কাঠ কিনে ক্রেতার জমিতে ঘর বানাতেন। 'এই এলাকা নদীভাঙন প্রবণ হওয়ায় ২০ থেকে ৩০ বছর আগে কাঠমিস্ত্রিরা এমন ঘর বানানো শুরু করেছিলেন, যা অন্য জায়গায় সরানো যায়।'
তিনি বলেন, 'এখন মানুষ এমন ঘর চায় যা সহজে বানানো যায় এবং তারা নিজের জায়গায় ঘর নির্মাণের ঝামেলা নিতে চায় না। তাই আমরা গত কয়েক বছরে এই ধরনের স্থানান্তরযোগ্য ঘর তৈরি শুরু করেছি।'
বিক্রেতারা জানান, এই ঘরগুলো সস্তা কারণ তারা কাঠ, টিন ও অন্যান্য উপকরণ একসঙ্গে বড় পরিমাণে কিনে এক জায়গায় ঘর বানান। এতে অপচয় কমে যায় এবং খরচও কমে।
আব্দুর রবের হিসাব, মুন্সিগঞ্জে সাত লাখ টাকায় বিক্রি হওয়া একটি ঘর ক্রেতা যদি নিজে সরঞ্জাম কিনে এবং মিস্ত্রি দিয়ে বানাতেন, তাহলে খরচ হতো প্রায় ১০ লাখ টাকা। সঙ্গে সময় এবং দেখভালের ঝক্কিও থাকতো।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিটি ঘর বিক্রি থেকে বেশি লাভ করার দিকে মনোযোগ দিই না। লক্ষ্য হলো বেশি বিক্রি করা। প্রতিযোগিতা বেশি, তাই সবাই কম মুনাফায়ও বেশি বিক্রি করতে চায়। পাশাপাশি আমাদের পদ্ধতিতে কাঠের অপচয়ও খুব কম।'
তবে গত কয়েক বছরে লাভ কমেছে, জানালেন সাকিব সরদার, কারণ কাঠ, টিন এবং শ্রমের খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষও খরচে বেশি সতর্ক।
তিনি দাবি করেন, চার বছরের মধ্যে কাঠের দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে, আর টিনের দাম প্রায় দ্বিগুণ। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দাম বাড়ানোও কঠিন।
সরদার জানান, ঘর তৈরি, বিক্রি ও সরবরাহের পাশাপাশি কাঠমিস্ত্রিরা বিক্রয়ের পরও সেবা দিয়ে থাকেন। 'প্রয়োজনে আমরা বিক্রয়-পরবর্তী সেবাও দিই। ঘর ডেলিভারির সময় বা পরে কোনো ক্ষতি হলে আমরা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করি।'
তিনি আরও পরামর্শ দেন কীভাবে ঘরগুলো ভালো রাখলে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
'ঘর ভালো রাখার একটা উপায় আছে। এর প্রধান শত্রু হলো সরাসরি দীর্ঘ সময়ের জন্য সূর্যালোক; এটি কাঠকে বাঁকাতে পারে। আমার পরামর্শ, শীতে বছরে একবার মোটর অয়েল লাগানো উচিত, যেন ঘরগুলো ভালো থাকে এবং আরও বছরের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়।'
যে উদ্যোগটি নদীর বাঁক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ থেকে জন্ম নিয়েছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী মূল্যের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবসায়ে। ব্যবসায়ী, কারিগর ও ক্রেতারা একমত, এটি সেই সমস্যা সমাধান করে যা অনেকেই এড়াতে চান। যেমন— নির্মাণের ঝামেলা, সময়ের অপচয় এবং নিয়মিত তদারকি।
কাঠের ঘরের সারির মাঝে দাঁড়িয়ে আহাদুল্লাহ বলেন, তিনি পছন্দের ঘর খুঁজে পাবেন, এমন আশা করছেন। 'যদি কিছু ভালো লাগে, আমি হয়তো বন্ধুদেরও বলব। আমরা একসঙ্গে কাঠের ঘর কিনে খামারে ছুটির দিনগুলো আরাম এবং আনন্দের সঙ্গে কাটাতে পারব।'
চাহিদা এবং সুবিধার কারণে এই চলন্ত কাঠের ঘর ক্রমেই দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে, আর ক্রেতাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।