যুক্তরাষ্ট্রের ছাড়, রাশিয়াকে রূপপুরের পাওনা পরিশোধে উদ্যোগী সরকার

রেজাউল করিম বায়রন
রেজাউল করিম বায়রন
আসিফুর রহমান
আসিফুর রহমান
17 August 2025, 05:55 AM
UPDATED 17 August 2025, 17:41 PM

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া পরিশোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল (ওএফএসি) থেকে অস্থায়ী ছাড় পাওয়ার পর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আগস্টের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের অধীনস্থ সংস্থা ওএফএসি—যারা মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে—ঢাকাকে শর্তসাপেক্ষে এই অর্থ পরিশোধের অনুমতি দিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার শর্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এরপর থেকেই অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ পরিশোধের এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ঢাকায় অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসে চিঠি পাঠিয়েছে জানতে চেয়েছে, কীভাবে এই অর্থ পরিশোধ করা যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কারিগরি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে।

ইআরডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'রাশিয়ার পক্ষ থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেলে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত ছাড়ের জন্য আবারও ওএফএসিতে পাঠানো হবে।'

ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বিষয়টি নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

তিনি বলেন, 'প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা তথ্য শেয়ার করব।'

ইআরডির আরেক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আরও কয়েকটি দেশ ওএফএসি থেকে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কিছু লেনদেন করার অনাপত্তিপত্র পেয়েছে। বাংলাদেশও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে।

নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগেই শুরু হওয়া বেসামরিক প্রকল্পগুলোর জন্য এই লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছে ওএফএসি।

গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন ট্রেজারিতে অর্থ পরিশোধের অনুমতি চেয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এই সুযোগ পেয়েছে।

একই মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বৈঠকেও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশও রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ বন্ধ করে দেয়।

পশ্চিমা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে রাশিয়ার প্রধান ব্যাংকগুলো—যার মধ্যে রয়েছে রূপপুর প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (ভিইবি)। এই ব্যাংককে বিশ্বব্যাপী লেনদেনের জন্য ব্যবহার হওয়া সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) সিস্টেম ব্যবহার থেকে বিরত রাখা হয়। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন সম্পন্ন হয়।

এই নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থায়নে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ও সুদ পরিশোধের অর্থ একটি তৃতীয়পক্ষের অ্যাকাউন্টে রাখতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অ্যাকাউন্টকে এসক্রো অ্যাকাউন্টও বলা হয়। এই অ্যাকাউন্টে লেনদেনের অর্থ সাময়িকভাবে রাখা হয়।

গত জুন পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টে ১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে। যেখান থেকে স্থানীয় ঠিকাদারদের ১৮৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, রাশিয়ার পক্ষ থেকে অর্থপ্রদানের চ্যানেল ও মধ্যস্থতাকারীর তথ্য পেলে তারা আবারও ওএফএসির অনাপত্তিপত্র চাইবেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ওয়াশিংটন ও মস্কো অর্থপ্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে একমত হলে তারা তহবিল ছাড়তে প্রস্তুত।

তিনি বলেন, 'এই অর্থ দেওয়া সম্ভব হবে কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত না। তবে আলাদা অ্যাকাউন্টে সেটা রাখা আছে। কাজেই আমরা এই অর্থ দিতে প্রস্তুত।'

নিষেধাজ্ঞার পর থেকে রাশিয়া বারবার অর্থ চেয়েছে। এমনকি তারা তাদের মুদ্রা রুবলেও এই অর্থ নিতে রাজি ছিল।

বাংলাদেশও এই অর্থ পরিশোধে বিকল্প পথ খুঁজেছিল। চীনের একটি ব্যাংকের মাধ্যমেও অর্থ পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে চীনা ব্যাংকগুলো এই প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আর এগোয়নি।

২০১১ সালের এক চুক্তির অধীনে ইউরেশীয় পরাশক্তি রাশিয়া ২০১৩ সালে প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৬ সালে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়।

নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সুদ ও অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করেছিল। এরপর থেকে মূলধন ও সুদ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। মূলধন পরিশোধ শুরুর সময় পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবেও রাজি হয়নি দেশটি।

বর্তমান সময়সূচি অনুযায়ী, ২০২৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। প্রতি বছর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দুটি কিস্তিতে ২০ বছর মেয়াদে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ইউনিট এ বছরের ডিসেম্বরেই বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার কথা। দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে চালু হবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।