সংগ্রামের সুর: সলিল চৌধুরীর গানে গণমানুষের মুখ
১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর আসামের লতাবাড়ি চা-বাগানের চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সলিল চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই তার প্রতি সঙ্গীতের আকর্ষণ ছিল প্রবল। এই অনুরাগ জন্ম নিয়েছিল বাবার কাছ থেকে, তবে আরও প্রসারিত হয়েছিল তার জ্যাঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরীর সাহচর্যে। পরিবারের এই সঙ্গীতপ্রেম, অনুকূল পরিবেশ, পারিবারিক আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক প্রেরণা মিলিত হয়ে তৈরি করেছিল সলিলের মধ্যে সঙ্গীতচর্চার প্রাথমিক ভিত্তি। ছোটবেলাতেই তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হন।
১৯৪৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসার পর তার সংযোগ স্থাপিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সাথে। এখান থেকেই গণসঙ্গীতে তার আগ্রহ ও উৎসাহ জন্ম নেয়। 'গণনাট্য ৭০ স্মারকগ্রন্থে' অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'কথা প্রসঙ্গে সলিল দা বললেন, দ্যাখ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মাটি না কোপালে সলিল চৌধুরীর জন্ম হতো না।'
সলিল চৌধুরী কেবল বাংলা ভাষার সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। হিন্দি, মালয়ালাম, ওড়িয়া, অসমীয়া, তামিল, তেলুগু, মারাঠি, কন্নড়, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষার চলচ্চিত্রেও তার সুরারোপিত গান রয়েছে। তবে তার সাফল্যের আসল রহস্য ছিল জনমানসের হৃদস্পন্দনকে বোঝার ক্ষমতা। সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনা—এসবই তার সৃষ্টির মূল উপজীব্য। তিনি এটি শিখেছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রবহমান ধারার মাধ্যমে, যেখানে সমাজের সংকট ও সাধারণ মানুষের গল্পই ছিলো শিল্পচর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দু।
গণসঙ্গীতে সলিলের অবদান
সলিল চৌধুরি গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে দ্বৈত প্রতিভা ছিলেন— গীতিকার এবং সুরকার। তার কাজের দুই ধাপ, বাণী রচনা এবং তাতে সুরারোপ, একযোগে জনজীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হতো। রবীন্দ্রনাথের 'সঙ্গীত চিন্তা' গ্রন্থে লেখা অভিমতটি সলিলের সঙ্গীতচর্চার জন্য প্রাসঙ্গিক, 'সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।'
সলিলের সঙ্গীতে সেই প্রাণশক্তি ছিল। গণসঙ্গীতের মাধ্যামে তিনি জনতার আবেগ ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। একদিকে তিনি বাঁশি, এসরাজ, বেহালা, সেতার, পিয়ানো, গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে নিপুণ হয়ে উঠছিলেন, অন্যদিকে গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত থেকে সরাসরি জনসংযোগের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করছিলেন। এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি বোঝেন, যে শিল্পী সরাসরি গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তার সঙ্গীত স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত ও প্রভাবশালী হয়।
১৯৮৮ সালে কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত গণসঙ্গীত কর্মশালায় তিনি বলেছেন, 'প্রত্যক্ষভাবে যারা গণআন্দোলনে জড়িত নন, গণআন্দোলনকে যারা নিজের করে নিতে পারেননি, তাদের কাছে গণসঙ্গীত তাত্ত্বিক কচকচি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায় বিভিন্ন গণআন্দোলনের শরিক হিসাবে যে শিল্পীরা কাজ করেন তাদের গলায় যে সঙ্গীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়, তা লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, আধুনিক সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, পাশ্চাত্য প্রভাবিত সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, তার বক্তব্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সংগ্রামের ছবি ফুটে ওঠে।'
এই দর্শনের ভিত্তিতে সলিল সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুরের ছোঁয়া দিয়ে তৈরি করেন 'রানার' বা 'অবাক পৃথিবী', এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় সৃষ্টি করেন 'পাল্কীর গান' প্রভৃতি কালজয়ী গান।
সলিল চৌধুরী কেবল গান রচনা করতেন না; তিনি তা গাইতেনও। এতে তার বক্তব্য জনমানসে পৌঁছাত সরাসরি, শিল্পীর অন্তর্নিহিত আবেগ ও সংগ্রামের দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটত। গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতেন, যা শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করত।
বাণী ও বার্তা: সাধারণ মানুষের ভাষা
সলিল চৌধুরির গানগুলো জনজীবনের সমস্যা, সংগ্রাম, আশা এবং বঞ্চনার প্রতিবাদকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি 'গণসঙ্গীত প্রসঙ্গে' উল্লেখ করেছে, 'এই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সর্বহারা শ্রেণি সাধারণ মানুষের সামনে তার সমগ্র বক্তব্য শিল্পীতভাবে উপস্থাপন করতে চায়, এবং তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি ও যুক্তি ব্যাপক মানুষের চিত্তে সঞ্চারিত করতে চায়।'
বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় 'কালচার' শব্দের নিহিতার্থের সঙ্গে 'কালটিভেশন' বা 'চাষ'কে তুলনা করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ সলিলের 'হেই সামালো ধান হো' গানটিতে খুঁজে পাওয়া যায়। গানে ধান রোপণ ও সংরক্ষণের আহ্বান আছে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সমগ্র কৃষক শ্রেণীর দীর্ঘমেয়াদি শোষণের শিকার হওয়া এবং জমিদার–জোতদার কর্তৃক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা। কৃষকের শ্রমের ফসল হিসেবে উৎপন্ন ধান চিরকালই চলে যায় জোতদারের গোলায়। তাই সলিল লেখেন, 'হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো/ জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেবো না, আর দেবো না, যত্নে গড়া ধান মোদের প্রাণ হো।'
কৃষক ও শ্রমিকদের দৈনন্দিন সংগ্রাম থেকে সৃষ্ট এই গানটি শুধু একটি আহ্বান নয়, বরং জনতার মধ্যে সচেতনতা এবং ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের উদ্দীপনা জাগানোর এক শক্তিশালী মাধ্যম। এতে জনজীবনের স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং ত্যাগের অনুভূতি সবই প্রতিফলিত হয়েছে।
সলিল চৌধুরীর সর্বাধিক পরিচিত ও আলোচিত দীর্ঘ কবিতা 'শপথ'-এর কথা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে । ১৯৪৮ সালের ৬ নভেম্বর, সুন্দরবনের চন্দনপিঁড়ির তেভাগা মিছিলে রাইফেলধারী পুলিশ গুলি চালায়। তাতে অহল্যা, বাতাসি, সরোজিনী, অশ্বিনী, গজেন এবং দেবেন নামের নিরস্ত্র সংগ্রামী মানুষেরা প্রাণ হারান। এই অহল্যা ছিলেন তখন সন্তানসম্ভবা।
এছাড়াও কেরালার কাইয়ুর কৃষকদের ফাঁসিতে শাস্তি দেওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট প্রতিবাদী গান যেমন-
'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা/ আজ জেগেছে সেই জনতা/ তোমার গুলির তোমার ফাঁসির/ তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা ওজনে তা – এই জনতা।'- তার চিরভাস্বর কীর্তি।
এই গানগুলো বিশেষভাবে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাশীলদের অপকীর্তির প্রতিবাদ হিসেবে জনমানসে সচেতনতা জাগানোর উদ্দেশ্য বহন করে। এটি গণসঙ্গীতের মাধ্যামে ক্ষমতাসীনদের প্রতি সরাসরি সমালোচনার এক নিখুঁত উদাহরণ।
রাজনৈতিক ও সামাজিক সমালোচনা
সলিল চৌধুরী কেবল কৃষক বা শ্রমিকদের জন্য গান করেননি; তিনি সমালোচনা করেছেন স্বাধীনতার পরের ছদ্ম দেশপ্রেমিক, পুঁজিপতি এবং রাজনৈতিক নেতাদেরও। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এই গানটির কথা— 'ও ভাইরে ভাই/ মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই।'
এতে আত্মপ্রচারকারী 'জনদরদী'দের সমালোচনা আছে, যারা দেশের নাম ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করছিল। একইভাবে 'আমার ভিটেয় চরল ঘুঘু ডিম দিল তোমাকে' গানটি স্বাধীনতার স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে বিদ্রূপাত্মক ও তিক্ত মন্তব্য প্রকাশ করে।
সলিলের দেশপ্রেম নিখাদ ছিল। তার 'ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে'তে লিখতে দেখা যায়—
'তোমারই সন্তান মোরা তোমারই সন্তান/ তুচ্ছ বিভেদ-বিষে কত হয়েছি হয়রান/ তখন দেখি নি মা ঘরে ঘরে কেঁদে কাটাও কাল/ আর গোপনে মরণে কাটে সর্বনাশের খাল।'
এতে তিনি খাদ্যসঙ্কট, দুর্ভিক্ষ এবং সাধারণ মানুষের বিপন্নতা উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া তার লেখা প্রথম গান 'কোনো এক গাঁয়ের বধূ'-র কথা না বললেই নয়। স্বাধীনোত্তর বাংলায় মুনাফাবাজদের কূটচালার মাধ্যমে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের হাহাকার ফুটিয়ে তোলে এই গান৷ এখানে তিনি লেখেন, 'ডাকিনী যোগিনী এলো শত নাগিনী/ এলো পিশাচেরা এলো রে/ শতপাকে বাঁধিয়া নাচে তাতা তাধিয়া/ নাচে তাতা তাধিয়া নাচে রে/ কুটিলের মন্ত্রে শোষণের যন্ত্রে গেল প্রাণ শত প্রাণ গেল রে।'
সলিলের সঙ্গীত শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়; এটি আন্দোলনের হাতিয়ার। তার গানগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমনে সচেতনতা জাগাতে সাহায্য করে।
জনতার আহ্বান ও সংগীতের শক্তি
সলিল চৌধুরী জনতার সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে সংগীতকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি শুধুমাত্র গীতিকার বা সুরকার ছিলেন না; তিনি আন্দোলনের অংশীদার, সতর্কবার্তার প্রেরক এবং সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধকর্তা। তার গানগুলো জনসাধারণকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিল, যেমন—
'আহ্বান, শোন আহ্বান/ আসে মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে/ দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মতো বেরিয়ে।/ যুগ সঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া, হিমগিরি শুনলো কি সূর্যের ইশারা/ যাত্রা শুরু, উচ্ছল রোলে, দুর্বার বেগে তটিনী...'
এই তটিনী শুধু নদী নয়, এটি সলিলের সঙ্গীতচারণার প্রতীক। এটি সাধারণ মানুষকে সংগ্রামী ও জাগ্রত রাখার আহ্বান বহন করে। সলিলের গানগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। খাদ্যসঙ্কট, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বা সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার তার আহ্বান সময়ের সীমা পেরিয়ে আমাদের কাছে এসেছে।
সলিল চৌধুরী কেবল একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না; তিনি জনমানসে অনুভূতি, সংগ্রাম এবং আশা–উদ্দীপনার সেতুবন্ধন স্থাপন করেছিলেন। গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সাধারণত মানুষের কণ্ঠকে সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। তার সৃষ্ট গানগুলো আজও আন্দোলন, প্রতিবাদ ও আশার বার্তা বহন করে। জনমানসের সঙ্গে একাত্ম থাকার এক অনন্য বার্তা দেয়।