নারী কর্মকর্তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে: লিনু

সামসুল আরেফীন খান
সামসুল আরেফীন খান
13 November 2025, 02:46 AM
নারী কর্মকর্তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে: লিনু

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলমের যৌন হয়রানির অভিযোগ দেশজুড়ে ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশের টেবিল টেনিসের কিংবদন্তি জোবেরা রহমান লিনু বলেন, এমন সমস্যা বহুদিন ধরেই ক্রীড়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লিনু তার অ্যাথলিটস কমিশনে কাজের অভিজ্ঞতা ও সমাধানের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলায় যৌন হয়রানির বিষয় সামনে এসেছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

জোবেরা রহমান লিনু: আমি যখন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) অ্যাথলিটস কমিশনের চেয়ারপারসন ছিলাম (২০১৯–২০২৩), তখনই প্রথম এই বিষয়টি আমার নজরে আসে। শেষ সাউথ এশিয়ান গেমসের সময় আমার দায়িত্ব ছিল সব অংশগ্রহণকারীদের খোঁজ নেওয়া—তারা কীভাবে অনুশীলন করছে, কোনো সমস্যা আছে কিনা, এসব বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি করে বিওএতে জমা দেওয়া। তখনই জানতে পারি কিছু ব্যাপার ঘটছে, তবে তখন কথা বলার সময় ছিল না।

কী ধরনের তথ্য পেয়েছিলেন তখন?

লিনু: অন্য খেলাগুলোতেও নানা সমস্যা আছে—কোচদের কেউ কেউ অপব্যবহার করেন, আবার কিছু খেলোয়াড়ও অন্যদের হয়রানি করে। বিভিন্ন জায়গার লোকজন আমাকে বলত, "আপা, আমাদের সঙ্গে এমন হচ্ছে।" আমি তাদের পরিচয় গোপন রেখে বিষয়গুলো বিওএকে জানাতাম। কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল, যারা বেশি জড়িত ছিল তাদের সতর্ক করা হয়।

জাহানারা যেহেতু প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে বিষয়টি বলেছে, এখন সবাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এগুলো অনেক দিন ধরেই চলছে। আসলে এটা শুধু খেলাধুলার ক্ষেত্রেই নয়, সব পেশাতেই এমন সমস্যা আছে। খেলাধুলাকে আলাদা করে দোষ দিলে তা ভালো শোনাবে না। মানুষ ভাববে, এসব শুধু নারী খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেই ঘটে।

আপনার খেলার সময়ও কি এমন ঘটনা ঘটত?

 লিনু: আমাদের সময় এমন কিছু দেখিনি। অন্তত আমি না। তখন আমরা সবাই ভাইবোনের মতো ছিলাম। অল্প বয়সেই অনেকবার বিদেশ গেছি, কিন্তু কখনও কোনো সমস্যায় পড়িনি। কিন্তু এখন যারা খেলায় আসছে—তাদের বেশিরভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তারা কিছু টাকা পেলে সহজেই প্রতারণার শিকার হয়।

যারা এ ধরনের কাজ করে, তারা ভাবে, "আমি করলে কেউ কিছু বলবে না।" কারণ মেয়েরা মুখ খোলে না। মুখ খুললে দল থেকে বাদ পড়তে হবে—এই ভয়ে অনেকেই চুপ থাকে। পরিবার তাদের আয়ে নির্ভর করে, তাই তারা চুপ করে সব সহ্য করে। কেউ কেউ শুধু দলে টিকে থাকার জন্য, কেউ আবার জীবিকা রক্ষার জন্য নীরবে নির্যাতন সহ্য করছে।

কিন্তু জাহানারার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অনেকেই সাহস পাচ্ছে। আপনি দেখবেন, ধীরে ধীরে আরও অনেক কিছু সামনে আসবে।

আপনি বিওএকে জানিয়েছিলেন। এরপর কিছু হলো না কেন?

 লিনু: আমার কাজ ছিল তথ্য জানানো, রিপোর্ট করা। আমরা ছয়জন সদস্য ছিলাম কমিটিতে, সবাই জানতাম কী ঘটছে এবং লিখিতভাবে বিওএকে জানিয়েছিলাম। কিছুটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এরপর আর কিছু হয়নি।

অনেক মেয়ে নাম প্রকাশ করতে চাইত না। কেউ কেউ অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে বলত, "আমাদের সঙ্গে এমন হচ্ছে, দয়া করে রিপোর্ট করুন।" তখন বুঝতাম না, কে ফোন করছে।

অনেকে ভয় পেত, নাম দিলে কোচ বাদ দিয়ে দেবে। ক্রিকেটেও একই ঘটনা ঘটেছে—ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। এটা বহুদিন ধরে চলছে, প্রতিটি ফেডারেশনে কিছু না কিছু আছে। আমার ধারনা, অন্তত গত ১৫ বছর ধরে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থা না নেওয়ায় কি এমন ঘটনা বাড়ছে?

 লিনু: হ্যাঁ, অবশ্যই বাড়ছে। কারণ আমরা প্রমাণ সামনে আনতে পারছি না। শুধু মুখে বললে হবে না, প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ না থাকলে অপরাধীরা বেঁচে যায়। ফলে অন্যরাও সাহস পায়।অনেকে সত্যিকারের ভুক্তভোগী, তারা জানিয়েছে, কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি।

এখন কীভাবে এগোনো উচিত বলে মনে করেন?

 লিনু: নারীদের খেলার ক্ষেত্রে—যেমন ক্রিকেট, ফুটবল—সেসব দলে নারী কর্মকর্তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের দেশে ভালো নারী সংগঠক আছেন, কিন্তু আমরা তাদের কাজে লাগাচ্ছি না। বিদেশে যদি পুরুষ ম্যানেজার নিয়ে মেয়েদের দল যায়, খেলায় নানা সমস্যা হলে তারা কি পুরুষ ম্যানেজারকে খুলে বলতে পারবে? কখনও না। একজন মেয়ে শুধু আরেকজন নারীকেই এমন কথা বলতে পারে। তাই প্রত্যেক ফেডারেশনে নারী কর্মকর্তা থাকা আবশ্যক।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী কর্মকর্তারা নিজেরাই জড়িত। তাদের ব্যাপারে কী করা উচিত?

 লিনু: যদি প্রমাণ হয়, অবশ্যই তাদের বরখাস্ত করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রমাণ। আমাদের দেশে সবাই কথা বলে, কিন্তু প্রমাণ থাকে না। খুন করলেও প্রমাণ লাগে—প্রমাণ না থাকলে সবাই মুক্তি পায়।

এই কারণে অপরাধীরা প্রমাণ না থাকার বিষয়টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, বারবার একই কাজ করে যাচ্ছে। আমি বলব, যেকোনো মেয়ের কাছে যদি সামান্য প্রমাণও থাকে, তারা যেন ভয় না পেয়ে সেটা সামনে আনে। অপরাধীরা শাস্তি পেলে ভবিষ্যতে এমন কাজ করতে দশবার ভাববে।