৩৩ ওষুধের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত: আশার আলো নাকি চ্যালেঞ্জের শুরু

মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
9 December 2025, 15:11 PM
UPDATED 9 December 2025, 21:27 PM
সরকার যদি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যথাযথ আলোচনা ও সমন্বয় করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে এটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ৩৩টি ওষুধের দাম কমানোর পাশাপাশি কিছু ওষুধের দাম নতুনভাবে নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উদ্যোগ। কারণ, ওষুধ এখন আর কেবল চিকিৎসার উপকরণ নয়। বরং মানুষের জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে জরুরি উপাদান।

তবে, এই উদ্যোগকে ঘিরে যেমন আশার আলো রয়েছে, তেমনি কিছু বাস্তব প্রশ্নও সামনে এসেছে।

ধরা যাক, এক গরিব শ্রমিক শরীরের কোনো সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওষুধ লিখে দিলেন। ফার্মেসিতে গিয়ে সেই শ্রমিকের পকেটে ও মাথায় হাত—পর্যাপ্ত টাকা নেই তার। ওষুধ কিনতেই যদি পুরো দিনের মজুরি শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাঁচার লড়াই কীভাবে সম্ভব?

দেশের হাজারো মা প্রতিদিন সন্তানের জন্য অপূর্ণ ডোজ ওষুধ কিনে অর্ধেক চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। ফলে রোগ বাড়ে। ওষুধ-ডাক্তার-হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে পরিবারটি নিঃস্ব হয়। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে ওষুধের দাম কমানোই প্রথম শর্ত।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মানুষের পকেট থেকে। এই চাপে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ওষুধের উচ্চমূল্যের কারণে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়। প্রায়শই চিকিৎসা মাঝপথে ছেড়ে দেয়। অনেক সময় রোগীরা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন মতো পূর্ণ ডোজ শেষ করতে পারে না। ফলে রোগ জটিল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক বা ক্যানসারের ওষুধ রোগীকে চরম অসহায় অবস্থায় ফেলে দেয়।

দাম কমানো হলে রোগী পূর্ণ ডোজ শেষ করতে পারবে। চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকবে না। এটি বড় এক অর্জন। দাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার যদি প্রকৃতপক্ষে দাম কমাতে সক্ষম হয়, তবে জনগণের জন্য এটি হবে স্বস্তির একটি বড় উপহার।

অন্যদিকে, সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ নিশ্চিত হলে স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হবে। ফলে স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে। কেননা ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক স্বস্তি বয়ে আনবে। অনেক সময় দেখা যায়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম এতটাই বেশি থাকে যে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সরকারের এই উদ্যোগের ফলে জনগণের চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশে কমে আসবে। স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সহজলভ্য করবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি দেশের উচিত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। যাতে কোনো মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। এই সিদ্ধান্ত সেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

এ ছাড়া, এই উদ্যোগটি দেশে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বাজারকে সংকুচিত করতে সাহায্য করবে। ওষুধের দাম নাগালের বাইরে থাকলে মানুষ বাধ্য হয়ে কম দামে নকল বা নিম্নমানের ওষুধ কেনে। ফলে তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। মানসম্মত ওষুধের দাম কমে আসলে মানুষ তা কেনার প্রতি আগ্রহী হবে। নকল ওষুধের ব্যবসা কমে যাবে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল দাম কমিয়ে বা নির্ধারণ করে সমস্যার সমাধান হবে কি? যেকোনো বড় সিদ্ধান্তের মতো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

প্রথমত, সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ওষুধ কোম্পানিগুলোর দিক থেকে। তারা যদি দেখে যে দাম কমানোর ফলে তাদের মুনাফা কমে যাচ্ছে, তাহলে উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে বাজারে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সরবরাহ সংকট তৈরি হতে পারে। যা আবার ভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে।

কেননা বাংলাদেশে ওষুধশিল্প একটি প্রতিযোগিতামূলক খাত। দাম অতিরিক্ত কমিয়ে দিলে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। যা গুণগত মানে প্রভাব ফেলতে পারে। মানহীন বা ভেজাল ওষুধের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

এ ছাড়া বাজারে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হলে বিপরীতে কালোবাজারি ও অতিরিক্ত দামের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা দাম কমানোর চাপে অনেক কোম্পানি হয়তো ওষুধের মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হতে পারে। মানসম্মত কাঁচামাল ও উন্নত উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল।

যদি দাম কমানো হয়, তাহলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ব্যয় কমাতে গিয়ে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।

তাই, সরকারের উচিত দাম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য কঠোর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় যদি স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর নাও হতে পারে।

ওষুধের দাম কমানোর এই উদ্যোগ যেন কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং জনগণের বাস্তব উপকারে আসে, সে জন্য সুষম নীতি ও শক্তিশালী বাস্তবায়ন কাঠামো জরুরি।

আমাদের মনে রাখাতে হবে, ওষুধ মানুষের জীবনরক্ষাকারী বস্তু। এখানে সামান্য অসতর্কতাও হতে পারে জীবনঘাতী। তাই সরকার, ওষুধ কোম্পানি ও সমাজের সব অংশকেই এই প্রক্রিয়ায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

কাজেই এই উদ্যোগকে কার্যকর করতে হলে সরকারের উচিত স্বচ্ছ দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। যেখানে চিকিৎসক, রোগী, ওষুধ কোম্পানি ও ভোক্তা অধিকার সংস্থা সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকবে। মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে দাম কমলেও গুণগত মান অটুট থাকে। বিকল্প নীতিমালা— যেমন: জেনেরিক ওষুধের প্রচার, হাসপাতাল পর্যায়ে ফ্রি বা স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু করা।

জনগণ চায় কমদামে ওষুধ। কিন্তু তারচেয়েও বেশি চায় নিরাপদ, সহজলভ্য ও মানসম্মত ওষুধ। তাই সরকারের প্রতিটি উদ্যোগে থাকতে হবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানের নিশ্চয়তা।

সরকার যদি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যথাযথ আলোচনা ও সমন্বয় করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে এটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।

এ জন্য জরুরি হলো গুণগত মানের নিশ্চয়তা। কালোবাজারি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও সবার জন্য সহজলভ্য ওষুধ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। দাম কমলো, কিন্তু মানহীন ওষুধ বাজারে এলো—তাহলে এটি হবে ভয়ংকর প্রতারণা।

এ ছাড়া, কালোবাজারি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনগণের জীবন নিয়ে খেলতে না পারে। আর সবার জন্য সহজলভ্য ওষুধ নিশ্চিত করার প্রশ্নে দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে হবে।


মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ