আগুনের রাজনীতিতে হারে কেবল সাধারণ মানুষ

জুবাইয়া ঝুমা
জুবাইয়া ঝুমা
15 November 2025, 11:04 AM
সহিংসতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে এই আগুন শুধু যানবাহন নয়, আমাদের ভবিষ্যৎও পুড়িয়ে দেবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে আবারও বেড়েছে অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা। একটা সময় মানুষ বলতো, শনিবার মানেই শনির দশা কাঁধে ওঠা। কিন্তু, এখন সপ্তাহের যেকোনো দিনেই শনির দশা সাধারণ মানুষের কাঁধে স্থায়ী বসবাসের জায়গা করে নিয়েছে।

রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহর ও গ্রামীণ জনপদ—সর্বত্রই অগ্নিসন্ত্রাসের ভয়। বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা দোকানপাট—কিছুই যেন নিরাপদ নয়। মানুষের মনে আতঙ্ক বেড়েছে অগ্নিসন্ত্রাস নিয়ে।

প্রতিটি আগুনের পর শুধু যানবাহনের ধ্বংসাবশেষই নয়, মানুষের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে ভয়, ক্ষোভ আর ক্লান্তির ছাপ।

রাজনীতির আগুনে পুড়ছে মানুষ

অগ্নিসন্ত্রাসের এই দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন না। দেশে যখনই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ে, রাস্তায় দেখা মেলে আগুনের। পেট্রোলবোমা যেন হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রতীক, এক ভয়াবহ 'অভিব্যক্তি', যার শিকার মূলত সাধারণ মানুষ।

যারা আগুন দেয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা নিরাপদ থাকে; যারা আগুন দেওয়ার হুকুম দেয়, তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে; কিন্তু ক্ষতি হয় সেই রিকশাচালক, কর্মজীবী বা অফিসগামী মানুষের। অথচ, এই রাজনীতির খেলায় ওই সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা নেই, প্রাপ্তি নেই। বিনা  কারণেই এসব নিরীহ মানুষের জীবিকার পথ রুদ্ধ হচ্ছে, কখনোবা রুদ্ধ হচ্ছে নিঃশ্বাস। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়।

এ ধরনের নৃশংসতা কখনোই গণআন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এটি পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ, যা রাজনীতির ভাষাকে নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি—প্রতিবাদ মানেই প্রতিহিংসা নয়।

এই সহিংসতার দায় কেবল একপক্ষের নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতা অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছে। কখনো দলীয় কর্মসূচির নামে, কখনো পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় রাজপথ পরিণত হয়েছে ক্ষমতার পরীক্ষাগারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগও মাঝে মাঝে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।

সমাধানের পথ কোথায়

এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তিনটি উদ্যোগ জরুরি—

১. দায়মুক্তির সংস্কৃতি শেষ করতে হবে। অগ্নিসন্ত্রাস বা সহিংসতায় যারা যুক্ত, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বিচারহীনতা কেবল আরও আগুন জ্বালায়।

২. রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে সংলাপের পথ খোলা রাখা। ভিন্নমতকে আগুন নয়, আলোচনা দিয়ে মোকাবিলা করাই পরিণত গণতন্ত্রের লক্ষণ। নিজেদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে নেতৃত্বের নৈতিক দায় অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

৩. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা হতে হবে নিরপেক্ষ ও দৃঢ়। নীরবতা বা একপাক্ষিক সমালোচনা সহিংসতার প্রশ্রয় দেয়। আগুনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে মানবিকতার জায়গা থেকে, রাজনৈতিক লাভের জন্য নয়।

আগুন পোড়াচ্ছে নিজ ঘর

অগ্নিসন্ত্রাস কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি সভ্যতার বিরুদ্ধে দেওয়া এক ঘোষণা। প্রতিটি জ্বলে যাওয়া বাস, প্রতিটি ভীত মুখ আমাদের জাতীয় আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে। সহিংসতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে এই আগুন শুধু যানবাহন নয়, আমাদের ভবিষ্যৎও পুড়িয়ে দেবে।


জুবাইয়া ঝুমা, পিআর প্রফেশনাল