মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে যে কিশোর বলেছিল—'আমি যাব'
১৯৭১ সাল। পুরো বাংলাদেশ তখন আগুনের মধ্যে। একের পর এক গ্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, নারীদের ওপর চলছে অবর্ণনীয় নির্যাতন।
এমনই এক সময়ে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম লাউচাপড়ার এক কিশোর সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর চুপ করে থাকবে না।
এই কিশোরই হলেন বীরপ্রতীক বশির আহমেদ।
বয়স তখন মাত্র ১৫ বা ১৬ বছর। ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। বই-খাতা বহন করার বয়সে তিনি দেখলেন তার চোখের সামনে পাকিস্তানি সেনারা মানুষ হত্যা করছে, গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য তার ভেতরের মানুষটাকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি ঠিক করে ফেলেন—দেশকে মুক্ত করতেই হবে।
বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধের পথে
এপ্রিল মাসে চারপাশের পরিচিত অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। বশিরও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে অনুমতি মেলেনি।
তখন এক ভাগনেকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি বাড়ি ছাড়েন তিনি। গন্তব্য ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প।
কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হয়। নতুন মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করছিলেন তারই শিক্ষক সোলায়মান হক।
বশিরকে দেখে তিনি বলেন, 'তুই অনেক ছোট। যুদ্ধ করা তোর পক্ষে সম্ভব না।'
শিক্ষকের কথা ফেলতে পারেননি বশির। ফিরে আসেন। কিন্তু মন থেকে যুদ্ধের আগুন তখনো নিভে যায়নি।
বাড়ি না ফিরে মহেন্দ্রগঞ্জেই এক আত্মীয়ের বাসায় প্রায় ১৫ দিন কাটান। মে মাসে নতুন করে সদস্য নেওয়া হচ্ছে শুনে আবার হাজির হন ক্যাম্পে।
এবার তিনি বলেন, 'স্যার, আমি মরা–বাঁচা নিয়ে ভাবি না। আমি যুদ্ধে যাবই।'
এই দৃঢ়তা আর চোখের আগুন সোলায়মান হককে ভাবিয়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত বশির আহমেদ হয়ে ওঠেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।
যুদ্ধ আর এক অবিশ্বাস্য দায়িত্ব
বশির আহমেদ ১১ নম্বর সেক্টরে হেলাল কোম্পানির অধীনে যুদ্ধ করেন। পরে মিত্রবাহিনীর সঙ্গেও যুক্ত হন। কখনো রেকি, কখনো দোভাষী, আবার কখনো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় আসে কামালপুরে।
কামালপুর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এটিকে বলা হতো উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় ঢোকার প্রবেশদ্বার। আর এই ঘাঁটি দখল করাই ছিল মুক্তিবাহিনীর বড় লক্ষ্য।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কামালপুর ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনী। টানা ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকে পাক সেনারা। খাবার, গোলাবারুদ—সবই ফুরিয়ে আসছিল। একসময় কেবল একটি বিষয়ই বাকি ছিল—আত্মসমর্পণ।
কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী রাজি হচ্ছিল না।
'কে যাবে চিঠি নিয়ে?'
ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে মিত্রবাহিনী সরাসরি যুক্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয়—পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হবে।
তখন ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং পরিষ্কার প্রশ্ন করেন, 'পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে চিঠি নিয়ে?'
চারপাশে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। কেউ সাহস করে কথা বলেননি। কারণ সবাই জানতেন—এটা প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু।
ঠিক তখনই একজন কিশোর সামনে এগিয়ে আসে। বলে, 'আমি যাব'।
সেই কিশোরই হলেন বশির আহমেদ।
শত্রু ক্যাম্পে একা
এক হাতে সাদা পতাকা, অন্য হাতে আত্মসমর্পণের চিঠি। এই সামান্য সম্বল নিয়ে বশির হাঁটতে শুরু করেন কামালপুর ক্যাম্পের দিকে। চারপাশে ফাঁকা মাঠ, চারদিকে শত্রুর বন্দুক আর মৃত্যুর সম্ভাবনা।
তিনি সেখানে গিয়ে ডাকতে থাকেন। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে কেউ এগিয়ে আসে নি। উল্টো পাকিস্তানি সেনারা ইশারায় তাকে ক্যাম্পের ভেতরে ডাকতে থাকে।
জীবনের সব ভয় পেছনে ফেলে সেদিন তিনি এগিয়ে যান।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলেও তাকে হত্যা করা হয়নি। বরং একজন পাকিস্তানি অফিসার এগিয়ে এসে বলেন, 'মুক্তি, তুম মাত গাবরাও'।
তাকে খাবার দেওয়া হয়, নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পাক সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়—কেউ যেন তার কাছে না আসে।
ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত
এদিকে যৌথবাহিনী ধরে নেয়, বশির শহীদ হয়েছেন। শুরু হয় বিমান হামলা।
পরে দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল হক সঞ্জু গেলে চাপ আরও বাড়ে।
অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। আত্মসমর্পণে সম্মত হন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক।
এই আত্মসমর্পণ ছিল ঐতিহাসিক। কারণ এটি ছিল ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম আত্মসমর্পণ। ১৫০ জনের বেশি পাক সেনা ও সহযোগী সেদিন বাহিনী অস্ত্র নামিয়ে রাখে।
স্বাধীনতার পর বীরের আক্ষেপ
আজ স্বাধীনতা দিবসে বীরপ্রতীক বশির আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বয়ান তৈরি হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যারা অংশগ্রহণ করেছি, আমাদের তো এখন নামই নাই। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সে আকাঙ্ক্ষা তো এখন আর নাই। এ দেশ মুক্ত হবে, আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করব, স্বাধীন বক্তব্য দেব, দেশ ক্ষুধামুক্ত হবে—এগুলো তো এখন আর নাই'।
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশটা আমরা অনেকে কষ্ট করে স্বাধীন করেছি। যেন দেশটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত হয়—এটাই নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান'।