আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধ: অবিস্মরণীয় এক বীরগাথা
দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর। স্থান কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী। আগের দিন পাটশ্বরী দখল করে বাঘবান্ধায় এসে অবস্থান নিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআরের নায়েক উক্যচিং মারমা। আচমকা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি।
অনবরত আর্টিলারি, মর্টার ও মেশিনগানের গুলির মুখেও তখনো নিশ্চুপ মুক্তিযোদ্ধারা। সারা রাত গোলাবর্ষণের পরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিউত্তর না পেয়ে একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা থেমে যায়। পরদিন সকালে আগত ভারতীয় অফিসারদের নিয়ে রেকি করেন উক্যচিং। দিনভর তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণের ফাঁদ পাতেন।
রাত ৮টায় শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলা। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু উক্যচিংয়ের দেওয়া নিখুঁত পরিকল্পনা এবং এলএমজি ও গ্রেনেড দিয়ে পাতা ফাঁদের ফলে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। একপর্যায়ে রাতের আঁধারেই তারা পালিয়ে যায়। মুক্ত হয় ভূরুঙ্গামারী। এই যুদ্ধের জন্য একমাত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীর বিক্রম খেতাব পান নায়েক উক্যচিং মারমা।
কেবল এই একটিমাত্র অপারেশনই নয়। মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকেই ৬ নম্বর সেক্টরের একের পর এক যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন উক্যচিং। এসব যুদ্ধের মধ্যে হাতীবান্ধা, পাখিউড়া, রৌমারী, রায়গঞ্জ ও চৌধুরীহাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মার্চ মাসে যুদ্ধের শুরুতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন উক্যচিং। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার বিষয়ে জানতে পারেন ২৭ মার্চ। তিনি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একপর্যায়ে তার নেতৃত্বে বিওপিতে থাকা বাঙালি সেনারা সেখানে কর্মরত পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের আটক করে জনতার হাতে তুলে দিয়ে উক্যচিং মারমার নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দেন।
কেবল উক্যচিং মারমা একাই নন, তার মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এমন কয়েক হাজার আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এই আদিবাসীদের মধ্যে সমতলের আদিবাসী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন পাহাড়ি আদিবাসীরাও। কোনো আদিবাসীর বাস ছিল সীমান্তঘেঁষা জনপদে, কেউ বাস করেন সিলেট অঞ্চলের চা–বাগানে। যোগ দিয়েছিলেন আদিবাসী নারীরাও। সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ ছাড়াও সাধারণ মানুষের জন্য রাজভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজাও।
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের বীরত্বগাথা নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরিতে দেশের আটটি জেলা সফর করেছেন এই প্রতিবেদক। জেলাগুলো হলো—রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, রংপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা। এসব জেলা সফরকালে আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ বাসিন্দা, গ্রামবাসী ও রাজপরিবারের সদস্যসহ অন্তত ৪০ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বর্ণনায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের দুঃসাহসিক বীরত্বের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে একাধিক গ্রন্থে। আইয়ুব হোসেন ও চারু হকের লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী', তপন কুমার দের 'আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা' এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সাগরাম মাঝি ও বরেন্দ্র অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাগরাম মাঝি নামের এক আদিবাসী নেতার ডাকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে শত শত আদিবাসী যুবক রণাঙ্গনের যুদ্ধে অংশ নেন। তার উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যোগ দেন ওঁরাও, মুন্ডা, কড়া, কোল, মাহালী ও রাজওয়ারসহ অন্তত ১২টি গোষ্ঠীর চার শতাধিক আদিবাসী।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কেন্দুবুনা গ্রামে জন্ম সাগরাম মাঝির। বর্তমানে গ্রামটি সাগরামপাড়া নামে পরিচিত। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সাগরাম মাঝি এ অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে মুক্তির প্রধান বার্তাবাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাগরামপাড়া থেকেই অন্তত ২৫ জন আদিবাসী তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে তাদের কেউই আর জীবিত নেই। সাগরামপাড়ার মতো পার্শ্ববর্তী গোগ্রাম, রিশিকুল, মাটিকাটা ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে থাকা শত শত আদিবাসী তরুণ-যুবক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
তেমনই একজন মুন্ডা জনগোষ্ঠীর আদিবাসী নারায়ণ চন্দ্র মুরারি (৭২)। তার বাড়ি গোগ্রাম ইউনিয়নের বটতলী গ্রামে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ১৭-১৮ বছর বয়সী তরুণ। এপ্রিল মাসে স্থানীয় রাজাকারেরা এই অঞ্চলের অন্য আদিবাসী গ্রামগুলোর মতো বটতলীতেও ব্যাপক লুটপাট চালায়। প্রাণ বাঁচাতে বাকিদের মতো নারায়ণও শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন।
নারায়ণ বলেন, 'ভারতে আমরা বহরমপুরের হাতিনগর কলোনির শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিই। খাবারের জন্য রেশন কার্ড দেওয়া হয়। এর কয়েক দিন পরেই সাগরাম বাবু ক্যাম্পে এসে সব যুবকদের ডেকে বললেন, "সবাইকে এখন দেশের জন্য যুদ্ধে যেতে হবে। এ ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই। ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থাও করা হয়েছে।"'
নারায়ণ জানান, আদিবাসীদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। তবে একটি অংশ যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হচ্ছিল না। এ সময় সাগরাম মাঝি বহরমপুরের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটকে (এসডিএম) বলে তাদের রেশন বন্ধের নির্দেশ দেন। নারায়ণ বলেন, 'রেশন বন্ধ হলে খাবে কী? তখন অনেকেই যুদ্ধে গেল।'
সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা নাইকা কিসলুর (৭৮) বাড়ি তানোর উপজেলার মহাম্মদপুর গ্রামে। তিনি বলেন, 'আদিবাসী শরণার্থীরা যেসব ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল, তার প্রতিটি ক্যাম্পেই সাগরাম নিজে গিয়ে আদিবাসীদের যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরে নাম তালিকাভুক্ত করিয়েছিলেন।' তিনি গৌড়বাগান ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের পর মহদীপুর সাব-সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেছেন বলে জানান।
সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে প্লাটুন কমান্ডার বিশ্বনাথ টুডু, চম্পাই সরেন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ওঁরাওদের মধ্যে একমাত্র প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন রামপদ ওঁরাও (৮৩)। তিনি বলেন, 'আমরা ভগবানগোলায় প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভগবানগোলা ও লালগোলা ক্যাম্পে দুইশর বেশি আদিবাসীর প্রশিক্ষণ হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন প্লাটুনে বিভক্ত করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিল। আমার প্লাটুনে ৩০ জনের মতো আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পোড়াগ্রাম, রোহনপুর, শিবগঞ্জ, রাধাকান্তপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা তানোর ও মোহনপুর থানার ওপর তিন দফায় হামলা চালিয়েছিলাম। ২৯ নভেম্বর তানোর থানায় আমরা ত্রিমুখী আক্রমণ চালাই। আমাদের আক্রমণে একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। ৩০ নভেম্বর তানোর মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, আর একজন গুরুতর আহত হন।'
যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যাপক মূল্যও চুকাতে হয়। লুটপাটের পর আদিবাসী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা। ফলে দেশ হানাদারমুক্ত হলেও নিশ্চিহ্ন ভিটেতে ফিরতে হয় আদিবাসীদের।
গোদাগাড়ীর চৈতন্যপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জয়চাঁদ রাজওয়ার বলেন, 'যুদ্ধ শেষে ঘরভিটে বলে কিছুই নেই। সব চাষের খেত। রাজাকারেরা সেখানে সরিষার আবাদ করেছে। তখন বাধ্য হয়ে বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু তারপরেও একটা সান্ত্বনা ছিল, দেশ তো অন্তত স্বাধীন হয়েছে।'
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকা সূত্রে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন ৬২ জন আদিবাসী। যদিও প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।
প্রতিরোধ যুদ্ধে আদিবাসীরা
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রংপুরের আদিবাসীরা। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ৬)' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ২৫ ও ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা রংপুরে শহর, ক্যান্টনমেন্ট ও ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ব্যাপক পরিসরে গণহত্যা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাঁওতাল নেতা জয়রাম সরেন ও ওঁরাও নেতা বুদু ওঁরাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ আমজাদ হোসেন, মজিবর রহমান মাস্টারসহ রংপুরের নেতৃত্বস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। বৈঠকে ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২৮ মার্চ বিকেলে জেলার মিঠাপুকুরের বলদিপুকুর থেকে হাজারো সাঁওতাল ও ওঁরাও আদিবাসী ক্যান্টনমেন্ট দখলের উদ্দেশ্যে তির-ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে এসে ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী নিসবেতগঞ্জের ঘাঘট নদের পাড়ে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে তারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা শুরু করলে পাকিস্তানি সেনারা ১০টি জিপ থেকে মেশিনগান দিয়ে তাদের ওপর ব্রাশফায়ার করে। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে সেদিন শত শত আদিবাসীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঘাঘট নদের পানি। গুলিতে যেসব আদিবাসী আহত হয়েছিলেন, তাদের বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পাকিস্তানিরা।
রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আজাদ। তিনি বলেন, 'মিঠাপুকুরের বলদিপুকুর থেকে হাজারো সাঁওতাল ও ওঁরাও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা তির-ধনুক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখলের উদ্দেশ্যে আমাদের সঙ্গে নিসবেতগঞ্জে মিলিত হয়েছিল। সেদিন আদিবাসী নারীরাও ঘরে থাকেননি, বরং সম্মুখসারিতে অংশ নিয়েছিলেন। আজও ঘাঘট নদ সেই রক্তমাখা ইতিহাস বহন করে।'
বর্তমানে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশদ্বারে জয়মনি সরেনের একটি স্মারক ভাস্কর্য রয়েছে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধের পরপরই উত্তরবঙ্গজুড়ে পাকিস্তানিদের নিপীড়ন তীব্র হয়ে ওঠে। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ৩০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী।
সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা
আইয়ুব হোসেন ও চারু হকের লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার অঞ্চলে মণিপুরি, খাসিয়া, বড়াইক, রাজবংশীসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ১ হাজার ২০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন আদিবাসী নীলমণি চট্টোপাধ্যায়।
মণিপুরি আদিবাসীদের মধ্যে গিরীন্দ্র সিংহ, গ্রুপ কমান্ডার এল হরেন্দ্র সিংহ, সেকশন কমান্ডার এম মনমোহন সিংহ, বীরেশ্বর সিংহ, নীলচান দত্ত, আবদুল হামিদ মণিপুরি প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন।
মণিপুরি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী কুমার সিনহা (৭৮) বলেন, 'লোহারবন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমরা ৬ নম্বর কোম্পানির হয়ে যুদ্ধ করি। প্রথমে আমি খোয়াইয়ের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। পরে কমলপুর সাব-সেক্টরে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিই।'
তপন কুমার দে রচিত 'আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা' গ্রন্থ সূত্রে মণিপুরি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গিরীন্দ্র সিংহের বীরত্বগাথার বিবরণ পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। নিয়মিতই মাগুরছড়া ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালাতে মাইন পাততেন তিনি। সেপ্টেম্বর মাসে মাধবপুর অপারেশনের রেকি করার সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সপ্তাহখানেক পৈশাচিক নির্যাতনের পর পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করে। রণাঙ্গনের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সিলেট অঞ্চলের মণিপুরি, খাসিয়াসহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ।
সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে কেবল সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোতে সংঘটিত গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ছয় শর বেশি আদিবাসী। মুক্তিযুদ্ধের ১ মে শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা-বাগানের গণহত্যা ছিল তেমনই এক ঘটনা। এই গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ৪৭ জন আদিবাসী চা-শ্রমিক।
গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, ১ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা চা-বাগানে ঢুকে প্রথমেই নকুলা হাজরাকে হত্যা করেন। এরপর কাজের কথা বলে প্রায় ৬০ জনকে দলবদ্ধ করে কালীমন্দিরের সামনে জড়ো করে দুই দিক থেকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজন বিজয় হাজরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঞ্জাবিরা সেদিন পাখির মতো নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছিল। শহীদদের মধ্যে আমার বাবা ও এক ভাইও ছিলেন। আমার আরেক ভাই গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান।'
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ও বোমাং রাজপরিবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলে মং রাজা মংপ্রু সাইন ছিলেন ব্যতিক্রম। যুদ্ধের শুরুতেই শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মং রাজবাড়ি ও রাজভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন মংপ্রু সাইন। নিজের সংগ্রহে থাকা অস্ত্র ও গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন এবং রাজবাড়িতে আশ্রয়স্থল ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রণাঙ্গনের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শতাধিক মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসী। রাজা নিজেও রণাঙ্গনে সম্মুখসারিতে অংশ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল আখাউড়ার যুদ্ধ।
রামগড়ের মুক্তিযোদ্ধা চেইউরি মগ বলেন, 'মে-জুন মাসে রাজা শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।'
আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা উক্য চিং ছিলেন মারমা আদিবাসী। যুদ্ধের শুরুতেই লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা বিওপিতে কর্মরত এই ইপিআর সেনা ৯ জন বাঙালি সেনাকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অংশ নিয়েছিলেন ৬ নম্বর সেক্টরের বেশ কয়েকটি যুদ্ধে। ১৯ নভেম্বর রায়গঞ্জের যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন তিনি।
চাকমা রাজা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন চাকমা আদিবাসীরা। রাজপরিবারের সদস্য কে কে রায় নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রামগড়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন রমণী রঞ্জন চাকমা। বগুড়ায় শহীদ হয়েছিলেন ইপিআরের সিপাহি হেমরঞ্জন চাকমা।
যুদ্ধের শুরুতেই তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা চাকমা আদিবাসীদেরকে সংগঠিত করতে শুরু করেন।
দিনাজপুরের আদিবাসীরা
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই দিনাজপুরের বিরলের সীমান্তবর্তী রানীপুকুর ইউনিয়নের হালজায়, রঘুদেবপুর, আছুটিয়া, ঝিনাইকুঁড়ি ও তৎসংলগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামে বসবাসকারী সাঁওতাল, মুন্ডা, কড়া, ওঁরাও, মাহালী, তুরিহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শতাধিক আদিবাসী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআরের অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা জর্জ দাসের নেতৃত্বে গঠিত ভারতের গঙ্গারামপুর থানার শিববাড়ি প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এই আদিবাসীরা। এদের মধ্যে অনেকে প্রথমে সাব-সেক্টরের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিলেও পরে জর্জ দাসের নেতৃত্বাধীন জর্জ বাহিনীতে অংশ নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।
হালজায় গ্রামে বসবাসকারী বিলুপ্তপ্রায় কড়া আদিবাসীদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন যুদ্ধে অংশ নিলেও বর্তমানে কেবল জীবিত আছেন মুক্তিযোদ্ধা কিনা কড়া। ঝিনাইকুঁড়ি গ্রামের একটি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
কিনা কড়া বলেন, 'পাকিস্তানিদের নির্বিঘ্ন যাতায়াত ঠেকাতে নভেম্বর মাসে আমরা ঝিনাইকুঁড়ি গ্রামের ব্রিজ ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিই। নির্দিষ্ট দিন জর্জদার নেতৃত্বে আমরা ২০ জন আদিবাসী ঝিনাইকুঁড়িতে ব্রিজে ৪০ কেজি বিস্ফোরক লাগিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দিই।'
ময়মনসিংহ অঞ্চল
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গারো নেতা অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিনের নেতৃত্বে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দায় গারো পাহাড়ের পাদদেশে থাকা গারো, হাজং, কোচ, ভালু, হদি জনগোষ্ঠীর তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া কয়েকজন গারো সৈনিক আদিবাসী প্রশিক্ষণার্থীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের অভ্যন্তরে থাকা গারো ও হাজং জনগোষ্ঠী দেশত্যাগ করে। একপর্যায়ে তারা মেঘালয়ের শিববাড়ি, ডালু, গাছুয়াপাড়া ও ভুমনিকুড়াসহ শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেন। এদের মধ্য থেকেই পরে অনেকে যুদ্ধে যোগ দেন।
আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধারা
আদিবাসী নারীরা মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসারিতে এবং চিকিৎসাসেবাতেও অংশ নিয়েছিলেন। এমনই দুই গারো নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার সন্ধ্যা রানী সাংমা এবং ভেরোনিকা সাংমা।
একাত্তরের শুরুতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে জয়রামকুড়া ক্রিস্টিয়ান মিশনারি হাসপাতালে নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন সন্ধ্যা রানী সাংমা। যুদ্ধ শুরু হলে নার্সিং ছেড়ে তিনি খালাতো বোন ভেরোনিকা সাংমাকে নিয়ে পানিহাটা মিশনে চলে যান। পরে সেখান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জের চাপাহাতি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে ডা. পীযূষ কান্তি রায়ের সহযোগিতায় তারা দুজনে ১১ নম্বর সেক্টরের ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সেবা করার সুযোগ পান।
সন্ধ্যা রানী বলেন, 'মে মাস থেকে আমরা সেক্টর ১১-এর অধীনে বাগমারা ফিল্ড হাসপাতালে নার্স হিসেবে যোগ দিই। সেখানে আমরা গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতাম। হাসপাতালে নিয়মিতই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন।'
অক্টোবর মাসে তাদের জামালপুরের বকশীগঞ্জে পাঠানো হয়। এ সময় তারা বকশীগঞ্জে তাঁবু স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে রাজাকাররা তাদের অবস্থানের ওপর মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। তবে তারা বেঁচে যান।
সন্ধ্যা রানী বলেন, 'এই হামলার কয়েক দিন পরে আমরা জামালপুরে চলে যাই। এবং শেষ দুই সপ্তাহ জামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করি।'
রাখাইন নারী মুক্তিযোদ্ধা উ প্রিন্সা খে নার্স হিসেবে কাজ করতেন এবং পাশাপাশি গুপ্তচরবৃত্তিতে যুক্ত ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের শিকার হন; তবু মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি।
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের খাসিয়া আদিবাসী কাঁকন হেনইঞ্চিতা। একাত্তরের মার্চ মাসে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে তার মনমালিন্য দেখা দেয়। একপর্যায়ে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। এপ্রিল মাসে তার সঙ্গে বিয়ে হয় ইপিআরের পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সেনা মজিদ খানের। আগের সংসারে জন্মানো এক মেয়েকে আনতে তিনি আগের স্বামীর বাড়িতে যান জুন মাসে। এমন সময়ই মজিদ খানের বদলি হয়ে যায়। এদিকে পাকিস্তানি সেনারা তার বোন ও বোনের স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অন্যদিকে স্বামীর খোঁজে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরতে থাকেন কাঁকন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর চর সন্দেহে কাঁকনকে আটক করে। গোপন তথ্য উদ্ধারের নামে তার ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। তবু কাঁকনের এক কথা, তিনি স্বামীর খোঁজে এসেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কিছুই জানেন না। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা অনুসন্ধান করে মজিদ খানের খোঁজ পেয়ে কাঁকনকে ছেড়ে দেয়। তবে তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়। সম্ভ্রম ও স্বজন হারিয়ে প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়ে লক্ষ্মীপুর ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কাঁকনের।
যেহেতু কাঁকনের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সম্পর্ক ছিল, তাই তাকে মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তানিদের যাবতীয় চলাচলের তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেন কাঁকন। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের চলাচল বন্ধে জার্ডিয়া ব্রিজ ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিলে কলার ভেলায় বোমা ও গোলাবারুদ বহন করে ব্রিজে পৌঁছে দিয়েছিলেন কাঁকন। তিনি থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সফলভাবে এই ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে এই এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কেবল জার্ডিয়া ব্রিজই নয়, সুনামগঞ্জের বসরাই টেংরাটিলা যুদ্ধ, বেটিরগাঁও নুরপুরের যুদ্ধ, টেবলাইয়ের যুদ্ধ, মহব্বতপুরের যুদ্ধ ও সিলাইরপাড়ের যুদ্ধসহ ২০টির বেশি যুদ্ধে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে অংশ নিয়েছেন কাঁকন। একই সঙ্গে গোপনে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র চুরি করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে যাতায়াত বন্ধ করে দুরবিন টিলা, আঁধার টিলার সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য কাঁকন হেনইঞ্চিতা বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
নেত্রকোনার কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী লেঙ্গুরার ১৫ জন গারো নারী মুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। স্থানীয় সেক্রেড হার্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক গ্যাব্রিয়েল রাংসার অনুপ্রেরণায় তারা ভারতীয় ক্যাপ্টেন নিরঞ্জন সিং চৌহানের অধীনে কমলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। যদিও তাদের প্রশিক্ষণের পরপরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় তারা যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি।
এই আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা মল্লিকা ঘাগ্রা বলেন, 'যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রবল আগ্রহ থাকলেও ডিসেম্বর মাসে প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ায় আমরা সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিতে পারিনি।' তিনি আরও বলেন, 'তবে আমার ভাই এবং স্বামী যুদ্ধের শুরুতেই প্রশিক্ষণ নেওয়ায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।'
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঠিক কতজন আদিবাসী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এই সংখ্যা প্রকাশ করতে পারেনি সরকার। তবে মাতৃভূমিকে রক্ষায় দীপ্ত শপথে বলীয়ান এই আদিবাসীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে বিজয়ের পথ সুগম করেছিলেন, তা দিনের আলোর মতোই সত্য।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, 'যুদ্ধে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের চেয়ে আদিবাসীদের বেশি ক্ষতি করেছে। যুদ্ধের শুরুতেই আদিবাসীরা পাকিস্তানিদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সর্বস্বান্ত হওয়ার পরও আদিবাসীরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান নিয়ে যতটা কাজ হওয়া দরকার ছিল, তার কিছুই হয়নি। তারা সব সময়ই নিগৃহীত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে বীরত্বপূর্ণ অবদান ছিল, তা অনেকাংশে রাষ্ট্র বা বাঙালিরা অস্বীকার করেছে। মুক্তিযুদ্ধে যে তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান ছিল, তা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় আদিবাসীদের অবদান উল্লেখ না করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে।'