বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু থামেনি বাংলাদেশে

মোহাম্মদ জামিল খান
মোহাম্মদ জামিল খান
10 December 2025, 06:09 AM
UPDATED 10 December 2025, 12:33 PM

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর মতো অন্ধকার অধ্যায় হয়তো এবার শেষ হবে। কিন্তু এক বছর পার হলেও বাস্তবতা বদলায়নি। এসব মৃত্যু এখনো ঘটছে, আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন থামাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এ ধরনের মৃত্যু ও নির্যাতন চলতেই থাকার মূল কারণ বহু বছরের দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি। এখানে দায়ীদের খুব কমই জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়।

৩০ বছর বয়সী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসী হযরত আলীর মৃত্যু সেই বাস্তবতার নির্মম উদাহরণ। গত বছর ৬ ডিসেম্বর বাঞ্ছারামপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে তাকে আটক করা হয়। পরদিন পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় তার ক্ষতবিক্ষত দেহ।

তখন বাঞ্ছারামপুর থানার ওসি মোরশেদুল আলম কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। শুধু বলেন, যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে এবং আলীর বিরুদ্ধে কয়েকটি ডাকাতির মামলা ছিল।

শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পিয়াস বসাকের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। তবে আর খোঁজ নেননি।

আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছলিমগঞ্জ ইউনিয়নের আবদুল্লাহকে ঘিরে। চোর সন্দেহে স্থানীয়রা ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে আটক করে মারধর করে। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ হেফাজতেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। পাঁচ দিন পর আবদুল্লাহ মারা যান। এ ঘটনায় সাব-ইন্সপেক্টর মোহিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, এসব মৃত্যু দেখায় যে হেফাজতে নির্যাতন রোধে কাঠামোগত ব্যর্থতা আছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনে ২৯ জন মারা গেছেন। একই সময়ে কারাগারে ২৮ জন দণ্ডপ্রাপ্ত এবং ৫৫ জন বিচারাধীন বন্দির মৃত্যু হয়েছে।

গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কারা-হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২০। একই সময়ে ২৩ জন দণ্ডপ্রাপ্ত এবং ৪২ জন বিচারাধীন বন্দি কারাগারে মারা যান।

কারাগারে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক জান্নাত-উল-ফরহাদ বলেন, গত ১১ মাসে অসুস্থতায় ৯০ জন বন্দি মারা গেছেন। তার দাবি, কারাগারে কাউকে নির্যাতন করা হয়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, অনেক সময় আত্মহত্যা কিংবা গণপিটুনিতে আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যাওয়া ঘটনাগুলোও মানবাধিকার সংগঠনগুলো হেফাজতে মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত করে।

তার ভাষায়, 'অনেকে গণপিটুনিতে আহত হয়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। পরে মারা গেলে সেই ঘটনাও প্রতিবেদনে হেফাজতে মৃত্যু হিসেবে দেখানো হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'বিচারবহির্ভূত হত্যা বা হেফাজতে মৃত্যুর সব অভিযোগেরই তদন্ত চলছে। কিছু তদন্ত শেষ হয়েছে, কিছু এখনো চলছে।'

সাতটি হেফাজতে মৃত্যুর তদন্তের তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, দুজন গণপিটুনিতে নিহত, তিনজন আত্মহত্যা করেছেন এবং দুজন হৃদরোগে মারা গেছেন।

কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি

মানবাধিকারকর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন তদন্ত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ওপর আরও শক্তিশালী নজরদারি দাবি করেছেন।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, আগের সরকারগুলোর সময়ও নির্যাতন ও হত্যার ধারাবাহিকতা ছিল উদ্বেগজনক। অভিযুক্তরা আজও ক্ষমতায় আছে, কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। ন্যায়বিচারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি সতর্ক করে বলেন, পরবর্তী সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে অধিকার লঙ্ঘন ও হেফাজতে মৃত্যুর এই সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবই অনেক সময় সন্দেহ তৈরি করে।

তার মতে, 'কাউকে আটক করলে তার পরিবারকে জানাতে হবে। পরিবার যেন নিশ্চিত হতে পারে যে আটক ব্যক্তি জীবিত ও সুস্থ আছেন। এতে নির্যাতন ও অপব্যবহার কমবে।'