যুবদের শুটিং প্রশিক্ষণ ঘিরে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ
সাধারণ যুবদের জন্য সরকার "শুটিং প্রশিক্ষণ" চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনো নীতিমালা বা কঠোর তদারকি ছাড়া এ ধরনের কর্মসূচি নিয়ে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধবিদদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তারা সতর্ক করে বলেছেন—কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ও যথাযথ নজরদারি নিশ্চিত না করে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে এমন এক সমাজে, যেখানে অস্ত্রের অপব্যবহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উগ্রবাদ ও তরুণদের সহিংসতা আগেই বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।
বিশেষজ্ঞরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। তার আগে এখন এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কেন?
সরকারের "আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম" নামের এই প্রকল্প শুরু হবে ৮ নভেম্বর থেকে। ইতোমধ্যে অনলাইন নিবন্ধন শুরু হয়েছে। এতে মার্শাল আর্ট ও শুটিংসহ আত্মরক্ষা ও যুদ্ধকৌশল শেখানো হবে। কর্মসূচিটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ২০২৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) গত ১৬ অক্টোবর একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। এরপর ২০ অক্টোবর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে উদ্যোগটির ঘোষণা দেন।
তিনি লিখেছিলেন, 'দেশের ৭টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রাথমিকভাবে মোট ৮,৮৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণার্থীদের কারাতে, জুডো, তায়কোয়ানদো ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।'
"আগ্নেয়াস্ত্র" শব্দটি ব্যবহারের পরই শুরু হয় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি। পরদিন তিনি সংশোধন করে আরেকটি পোস্টে লেখেন, ১৮-৩৫ বছর বয়সী ৮,২৫০ জন যুবক ও ৬০০ জন যুব নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।' এবার তিনি "আগ্নেয়াস্ত্র" বাদ দিয়ে শুধু "শুটিং" লেখেন। তবে এই পোস্টের সাথে শেয়ার করা ছবিতে "আগ্নেয়াস্ত্র" শব্দটি এখনো দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে আসিফ বলেন, এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য গণ-আত্মরক্ষা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানো। তিনি দাবি করেন, অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল শেখানো হলেও "লাইভ ফায়ারিং", অর্থাৎ গুলি ছোড়া শেখানো হবে না।
ইতোমধ্যে প্রায় ৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, 'স্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ ক্ষতিকর হতে পারে।'
তার ভাষায়, 'এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রধানত এ ধরনের কোনো জাতীয় প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হলে সেটার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে যেটা সংসদে পাস করা হবে। এটা কোনো হালকা বিষয় না।'
তিনি আরও বলেন, 'যেসব দেশে এই ধরনের ন্যাশনাল সার্ভিস আছে, যেমন সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডে আছে—সেখানে এটার জন্য একটা জাতীয় কৌশল, নীতি এবং জাতীয় নীতিমালা আছে। এটা যদি খণ্ডিতভাবে করা হয়, তাহলে ভালোর চাইতে খারাপই হয়।'
মুনীরুজ্জামান অংশগ্রহণকারীদের যাচাই-বাছাই ও তদারকি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। 'কোন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করা হবে, কীভাবে নিরাপত্তা যাচাই হবে, প্রশিক্ষণের পর নজরদারি কীভাবে চলবে—এসব বিষয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া হয়নি।' বলেন তিনি।
তার মতে, 'এসব সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া এ উদ্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ। মুখে মুখে কাউকে রিজার্ভ ফোর্স ঘোষণা করা যায় না। এর জন্য নীতিমালা তৈরি করতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এ উদ্যোগ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে, কারণ জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশিক্ষণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে অনেকরকম সন্দেহও দানা বেঁধেছে, বিশেষ করে যখন আমরা নির্বাচনের খুব কাছাকাছি এসেছি।'
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, 'প্রশিক্ষণটি যদি কেবল খেলাধুলা বা শারীরিক অনুশীলনের জন্য হয়, তাহলে ইতিবাচক। কিন্তু যদি লক্ষ্য হয় জাতীয় প্রতিরক্ষা বা রিজার্ভ বাহিনী গড়া, তাহলে এটা অযৌক্তিক। কোনো কাঠামো, গবেষণা বা পরীক্ষামূলক পর্যায় ছাড়া এমন কর্মসূচি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক তরুণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা উগ্রবাদী শক্তির সঙ্গে যুক্ত এবং মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকে। এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণরা সহজেই কোনো পক্ষ বা মতাদর্শের প্রভাবে আসতে পারে। প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের মোকাবিলা করা কঠিন, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে।'
গত শনিবার বিকেএসপির প্রশিক্ষণ পরিচালক কর্নেল মো. গোলাম মাবুদ হাসান জানান, প্রশিক্ষণে তারা এয়ারগান ব্যবহার করবেন।
বিকেএসপির ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৫ দিনের আবাসিক এ প্রশিক্ষণ ১১৪টি ব্যাচে অনুষ্ঠিত হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হবে ঢাকা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও দিনাজপুরে।