আলো ঝলমলে মণ্ডপে শিল্প-ঐতিহ্যের মেলবন্ধন

সৌরভ হোসেন সিয়াম
সৌরভ হোসেন সিয়াম
27 September 2025, 15:38 PM
UPDATED 27 September 2025, 21:58 PM

মণ্ডপে মণ্ডপে আলোকসজ্জা আর বর্ণিল সাজে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। শহরের গলি থেকে মহল্লা সবখানেই চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আর একদিন পর দেবী দুর্গার আগমনে নগরী রূপ নেবে উৎসবের শহরে।

প্রতিটি মণ্ডপে ঐতিহ্য আর শৈল্পিকতার মেলবন্ধন দেখা যাচ্ছে। কোথাও মাটির ঘ্রাণ, কোথাও পাটের বুনন, সেইসঙ্গে শিল্পীর নিখুঁত তুলির টান। দেবীকে কোথাও জামদানী শাড়িতে সাজানো হয়েছে, কোথাও আবার অসুরবিনাশীর রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে সবার উদ্দেশ্য একটাই দেবীকে বরণের মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তোলা। ধর্মীয় আচার ছাড়িয়ে দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসবে।

যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে। আয়োজক কমিটিগুলোও তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছে। মণ্ডপগুলোকে রাখা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার সার্বক্ষণিক নজরদারিতে।

শুক্রবার ও শনিবার কয়েকটি পূজামণ্প ঘুরে দেখা গেছে, কারিগররা ব্যস্ত শেষ মুহূর্তের কাজ নিয়ে। প্রতিমায় রঙ তোলা, অলঙ্কার পরানো, আর মণ্ডপ সাজানোর কাজে দম ফেলার ফুরসত মিলছে না। কোথাও ঐতিহ্যবাহী থিম, আবার কোথাও নতুন সৃজনশীলতায় সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। সর্বত্রই নজর কাড়ছে ঝলমলে আলোকসজ্জা।

নিতাইগঞ্জের শ্রী শ্রী বলদেব জিউর আখড়া ও শিব মন্দিরে দেবীকে সাজানো হয়েছে জামদানী শাড়িতে। মণ্ডপের ভেতর ও বাইরে সজ্জার কাজ চলছিল। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে সেলফি প্রতিযোগিতা, যেখানে বিজয়ীরা পুরস্কারও পাবেন। এতে সহযোগিতা করছে একটি দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড।

দুর্গা.jpg
ছবি: স্টার

মন্দির কমিটির সভাপতি জয় কে রায় চৌধুরী বলেন, 'আমরা এ বছর দেশীয় পোশাককে গুরুত্ব দিয়েছি এবং সজ্জায় দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করেছি।'

১৪৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী আমলাপাড়া সার্বজনীন পূজামণ্ডপ এবারও আকর্ষণের কেন্দ্র। মাটি, বাঁশ, পাট আর গ্রামীণ নকশায় সাজানো মণ্ডপ যেন চিরন্তন বাংলার রূপ।

দুর্গা.jpeg
ছবি: স্টার

অন্যদিকে বরাবরের মতোই শৈল্পিক রূপে সেজেছে উকিলপাড়া হোসিয়ারী পূজামণ্ডপ। পোশাকে আর সজ্জায় আলোয় আলোকময়। নিখুঁত শিল্পকর্মে সজ্জিত এই মণ্ডপ এখন প্রস্তুত বরণের জন্য।

নিতাইগঞ্জের প্রজন্ম প্রত্যাশা পূজা উদযাপন কমিটি তাদের ৩০তম বার্ষিকী পালন করছে। এ উপলক্ষে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে রঙিন আলোকসজ্জায়, তৈরি করা হয়েছে বিশাল নান্দনিক তোরণ।

দূর্গা.jpeg
ছবি: স্টার

সাহাপাড়া সার্বজনীন পূজামণ্ডপেও চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। কারিগররা ব্যস্ত মণ্ডপের আশপাশের ডেকোরেশন নিয়ে। এবারের প্রতিমায় দেবীকে ঘরে আনা হচ্ছে হাতির পিঠে, যা অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক। পাশাপাশি প্লাস্টিক ব্যবহার সীমিত রাখার চেষ্টা করেছেন বলে জানান আয়োজকরা।

নয়ামাটি গিরিধারী মন্দিরে দেবীকে উপস্থাপন করা হয়েছে রণক্ষেত্রের যোদ্ধা রূপে।

এ মণ্ডপের তত্ত্বাবধায়ক প্রদীপ ঘোষ বলেন, 'আমরা এবারে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেছি। দেবীকে যোদ্ধার রূপে উপস্থাপন করেছি এবং গজা অসুরের দুটি অংশের ভাস্কর্য তৈরি করেছি।'

দুর্গা.jpeg
ছবি: স্টার

প্রতিবছর মণ্ডপ সাজানো আর আলোকসজ্জাকে ঘিরে মহল্লায় মহল্লায় প্রতিযোগিতা হয়। ব্যয়ের বড় অংশ মেটানো হয় জনসাধারণের স্বেচ্ছা অনুদান ও দাতাদের সহায়তায়, পাশাপাশি সরকারি অনুদানও থাকে বলে জানান পূজামণ্ডপের আয়োজকরা।

দুর্গা.jpeg
ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, এ বছর নারায়ণগঞ্জে ২২৪টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭৯টি, বন্দরে ২৯টি, রূপগঞ্জে ৪৪টি, সোনারগাঁয় ৩৫টি এবং আড়াইহাজারে ৩৬টি মণ্ডপ রয়েছে।

প্রতিটি মণ্ডপে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আনসার, স্বেচ্ছাসেবী, সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যও মোতায়েন থাকবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।

আলো, সঙ্গীত আর ভক্তির আবেশে মুখরিত নারায়ণগঞ্জ এখন দুর্গোৎসবকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি শুধু দেবী বরণ নয়, বরং সংস্কৃতি, সম্প্রীতি আর ঐক্যের উৎসব।