প্রার্থী-কর্মকর্তাদের স্বস্তি দিতে প্রস্তুতির সময় বাড়াল নির্বাচন কমিশন
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং ভোটগ্রহণের তারিখের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধান কমিশনের কর্মকর্তা ও প্রার্থী- দুই পক্ষকেই প্রস্তুতি নিতে আরও বেশি সময় দেবে। এমনটা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল প্রকাশ করে ইসি। তফসিল ঘোষণা ও ভোটগ্রহণের তারিখের মধ্যে ব্যবধান ৬৩ দিনের। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ ব্যবধান। ওই নির্বাচনে এই ব্যবধান ছিল ৭৪ দিনের।
আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে অনেক কম ব্যবধান ছিল। ইসির তথ্য থেকে দেখা যায়, এসব নির্বাচনে ব্যবধান ছিল ৩৯ থেকে ৫৯ দিন পর্যন্ত।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আবদুর রহমানেল মাছউদের ব্যাখ্যা, সময় বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রার্থীদের আরও স্বস্তি ও সুযোগ দেওয়া। সময়ের ব্যবধান দীর্ঘ হওয়ায় নির্বাচন প্রস্তুতি আরও গুছিয়ে নেওয়া যাবে এবং তাড়াহুড়ো কমবে। এতে প্রার্থী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের দায়িত্ব আরও সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমরা মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়েছি কারণ, আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রার্থীদের এখন আরও বেশি নথি জমা দিতে হবে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে তারা যেন অযথা চাপের মধ্যে না থাকেন এবং প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পান।
তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের জন্য দেওয়া সময় খুব কম—এ নিয়ে আগে অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন। কমিশন রিটার্নিং অফিসারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির জন্যও সময় বাড়িয়েছে।
সময়সীমা অনুসারে, মনোনয়নপত্র ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে হবে। রিটার্নিং অফিসাররা ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারির মধ্যে মনোনয়ন যাচাই-বাছাই করবেন। ১১ জানুয়ারি আপিলের শেষ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে এসব আপিল নিষ্পত্তি করবে। ২০ জানুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ এবং ২১ জানুয়ারি প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এরপর প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। এর মধ্যদিয়ে প্রচারণার সময় শুরু হবে। ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত প্রচারণা চলবে।
ইসির নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ এবং জমা দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। এই বছর, সময়কাল ১৮ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সাধারণ কাগজপত্রের পাশাপাশি প্রার্থীদের এখন অতিরিক্ত নথি জমা দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি সত্যায়িত কপি, বর্তমানে তারা কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কি না তার একটি বিবৃতি, অতীতের ফৌজদারি রেকর্ড এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রায়ের বিবরণ।
প্রার্থীদের তাদের পেশা বা ব্যবসার বিবরণ, সম্ভাব্য আয়ের উৎস এবং তাদের নিজস্ব বা নির্ভরশীলদের সম্পত্তি বা ঋণের একটি বিবরণও জমা দিতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে, যৌথভাবে, অথবা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নির্ভরশীলদের নেওয়া ঋণের বিবরণও জমা দিতে হবে। প্রার্থীর আগের নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং তার মধ্যে কতগুলো পূরণ হয়েছে তা প্রকাশ করতে হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তাদের নির্বাচনী এলাকার এক শতাংশ ভোটারের সই জমা দিতে হবে।
১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সর্বশেষ সংশোধনী অনুসারে, প্রার্থীদের এখন দেশে এবং বিদেশে সম্ভাব্য আয়ের উৎস, সেইসঙ্গে বাংলাদেশ এবং বিদেশে তাদের এবং তাদের নির্ভরশীলদের সম্পত্তি বা ঋণের পরিমাণ প্রকাশ করতে হবে।
এসব মনোনয়নপত্রের সঙ্গে এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময়কালও বাড়ানো হয়েছে।
গত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের করার জন্য রিটার্নিং অফিসারদের হাতে চার দিন সময় ছিল। এখন তারা ছয় দিন সময় পাবেন। রিটার্নিং অফিসারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য প্রার্থীরা সাত দিন সময় পাবেন, যা আগে পাঁচ দিন ছিল। আপিল নিষ্পত্তির জন্য ইসির হাতে সাত দিন সময় থাকবে। যা আগে ছিল ছয় দিন।
আপিল শুনানি এবং নিষ্পত্তি একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য চার কমিশনারের সামনে মামলাগুলো শুনানি হয়। আপিলকারীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে নিজেদের পক্ষ উপস্থাপন করতে পারেন। কমিশনকে পূর্ণ লিখিত রায় দিতে হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ইসিকে মাত্র ছয় কার্যদিবসের মধ্যে ৫৬৯টি আপিল নিষ্পত্তি করতে হয়েছিল, যার ফলে কর্মকর্তাদের গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছিল।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম এসব পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অতিরিক্ত সময় প্রার্থীদের তাদের কাগজপত্র আরও সাবধানে প্রস্তুত করার সুযোগ দেবে, যার ফলে বাতিলের কারণ হতে পারে এমন ভুলগুলোও কমবে।
তিনি বলেন, রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের কাজের চাপও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে দুই হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যদিও বেশির ভাগ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিন হাজার ৫৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল।
যদিও জাতীয় নির্বাচন সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়, তবে এই নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে হওয়া শেষ নির্বাচনের মাত্র দুই বছর পরই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।