ঢাকা বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড: অরক্ষিত মজুত ও অগ্নি নিরাপত্তার ঘাটতি দায়ী

জায়মা ইসলাম
জায়মা ইসলাম
রাশিদুল হাসান
রাশিদুল হাসান

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত ১৮ অক্টোবর আগুন লাগে। তদন্তে দেখা গেছে, পণ্য অরক্ষিতভাবে রাখা এবং পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

তদন্তে দুটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত হয়েছে—তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া রাখা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট।

তবে কেউ আগুন লাগিয়েছে বা নাশকতা করেছে—এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সই তদন্ত চালিয়ে ৩ নভেম্বরে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।

আগুন প্রথমে 'কুরিয়ার বিল্ডিং' নামে একটি স্থাপনায় লাগে। এটি আগে কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) লিজে ছিল এবং তাদেরই নির্মিত। সেখান থেকে আগুন আমদানি কার্গো অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

সংরক্ষণের এলাকা ছোট ছোট লোহার ঘরে ভাগ করা ছিল। সেখানে ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের মতো পণ্য রাখা ছিল।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো কিছু পণ্য "বিপজ্জনক পণ্য" হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ। এগুলোর জন্য নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা থাকা জরুরি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে টিনের ছাউনিওয়ালা পশ্চিম শেড থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। এই অংশটি তখন ডিএইচএলের লিজে ছিল।

আগুন সংরক্ষণের তাকের উপরের দিক থেকে শুরু হয় বলে মনে হয়। দুপুর ২টা ১৯ মিনিটে আগুনের শিখা দেখা দেয় এবং বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ ঘটে। দুই মিনিটের মধ্যেই পুরো ঘর আগুনে ঢেকে যায়।

ধোঁয়া ছড়ালেও কোনো স্প্রিঙ্কলার কাজ করেনি। দুপুর ২টা ১৯ মিনিটে কন্ট্রোল টাওয়ার বিমানবন্দরের রেসকিউ ও ফায়ার ইউনিটকে (এআরএফএফ) ফোন দেয়। জরুরি নির্দেশনা অনুযায়ী সাথে সঙ্গে জাতীয় ফায়ার সার্ভিসকে জানানো উচিত ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি।

প্রথম বিমানবন্দর ফায়ার ট্রাক আসে ২টা ২৩ মিনিটে। তখন পুরো ঘর আগুনে ছেয়ে গেছে। আরও দুটি ট্রাক আসে ২টা ২৫ ও ২৬ মিনিটে। প্রতিটি ট্রাকে ছিল ৯ হাজার ৫০০–১২ হাজার ৫০০ লিটার পানি এবং ১ হাজার ২০০–১ হাজার ৫০০ লিটার ফোম।

বিমানবন্দরের এক নিরাপত্তাকর্মী অবশেষে ৯৯৯-এ ফোন করেন ২টা ২৫ মিনিটে। এরপর উত্তরা ফায়ার স্টেশন খবর পায়। তাদের প্রথম ট্রাক পৌঁছায় ২টা ৫০ মিনিটে। তখন পুরো শেড আগুনে ঢেকে গেছে।

দুর্বল প্রস্তুতি

টিনের কাঠামো ভাঙা ছাড়া ভেতরে ঢোকা সম্ভব হচ্ছিল না। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ভাঙার যন্ত্র নেই। ফায়ার সার্ভিস বুলডোজার আনার পর আগুনের উৎসে পৌঁছানো যায়।

বিকেল ৩টা ২১ মিনিটে সেনাবাহিনী আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। মোট ৩৭টি ইউনিট কাজ করে।

কার্গো কমপ্লেক্সের কাছে পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্র্যান্ট ছিল না। তাই পানি আনতে দূরের জায়গা থেকে, যেমন বিমান হ্যাঙ্গার, বিমান ফায়ার স্টেশন, অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল, বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সুইমিং পুল, পাশের পুকুর এবং অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ভূগর্ভস্থ রিজার্ভার থেকে পানি আনতে হয়।

ঘটনার সময় কুরিয়ার ভবনে কেউ ছিল না। শনিবার হওয়ায় দুপুর দেড়টার মধ্যে অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে অনেকের কাছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও ব্যবহার হয়নি।

সব গ্রাউন্ড সাপোর্ট গাড়িতেই এক্সটিংগুইশার ছিল এবং কর্মীরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিমান কর্তৃপক্ষও ৩৪টি অতিরিক্ত এক্সটিংগুইশার বসিয়েছিল। কর্মীরা ২টা ৩২ মিনিটে নয়টি ২৫ লিটারের এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। তবে তখন আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

কার্গো কমপাউন্ডের একাধিক গুদাম আলাদা আলাদা কোম্পানির লিজে ছিল। আমদানি করা পণ্য নামিয়ে ওই কমপ্লেক্সে আনার দায়িত্ব ছিল বিমানের।

কুরিয়ার ভবনে ৫৭টি কুরিয়ার কোম্পানি কাজ করে। এর মধ্যে ১৩টি মূল ভবনে এবং ৪৪টি টিন শেডে বাইরে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিধিমালা ১৯৮৪ অনুযায়ী, পণ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব কুরিয়ার কোম্পানির। কিন্তু লিজ চুক্তিতে তা স্পষ্টভাবে লেখা নেই। এছাড়া, বেবিচকের অনুমতি ছাড়া ভবনের কাঠামো পরিবর্তন করা যাবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, টিনশেড কুরিয়ার ভবন বানিয়ে ছোট ছোট লোহার ঘরে ভাগ করার ফলে আগুন লাগলে সেখানে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। আইএইএবি এই কাঠামো দিয়ে বিমানবন্দরকে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছিল।

আরও বলা হয়, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বেবিচক বিমানবন্দর পরিচালনাকারী ও লিজদাতা। তাই ভবনের অনুমোদন, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব ছিল।

পথ বন্ধ ও কার্গো জট

আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল চারদিকে অগোছালোভাবে রাখা পণ্য। পণ্যের কারণে পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফায়ার ট্রাক ঢুকতে পারছিল না। ফর্কলিফট চালকরা রাস্তা খালি করার চেষ্টা করলেও ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী ২১ দিনের মধ্যে অবিক্রীত কার্গো সরাতে হয় এবং তিন মাসের মধ্যে নিলামে তোলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিয়ম মানা হয় না। ফলে স্থায়ী জট তৈরি হয়।

২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারির চিঠিতে বিমান কর্তৃপক্ষ জানায়, ১ লক্ষ ৫৮ হাজার ০০০ বর্গফুটের কার্গো কমপ্লেক্স প্রয়োজনের অর্ধেক। এক্সামিনেশন ইয়ার্ড না থাকায় কাস্টমস ছাড়পত্রে দেরি হয়। প্রতি বছর আমদানি ১০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় বাইরে পণ্য জমে থাকে।

বিমান ২১ দিনের পর অবিক্রীত কার্গোর তালিকা কাস্টমসে দিতে বাধ্য। তদন্তে দেখা গেছে তালিকা সময়মতো তৈরি হয় না। নিলামও দেরিতে হয়। ফলে জট আরও বাড়ে।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

লিজ চুক্তিতে প্রতিটি পক্ষের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

সব গুদাম, কার্গো শেড ও সার্ভিস ভবনে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

ডিএইচএলের এলাকায় এমন ব্যবস্থা ছিল কি না জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়ারুল হক তদন্ত চলছে জানিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

দীর্ঘদিনের অবহেলা

বিমানবন্দরে অগ্নিনিরাপত্তার ঘাটতির সতর্কবার্তা নতুন নয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিযোগ আছে।

১৪ বছর আগে ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর বিমান কর্তৃপক্ষ শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালককে জানায়, কার্গো গ্রাম ও কমপ্লেক্সে কোনো স্থায়ী আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নেভানোর ব্যবস্থা নেই। দেরি হলে কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হতে পারে এবং বিমানবন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।

এরপর এক জরিপ কমিটি হাইড্র্যান্ট, এক্সটিংগুইশার, অটো ফায়ার পাম্প ও ফায়ার ব্রিগেড সিস্টেম স্থাপনের পরামর্শ দেয়।

বিমানের নথি অনুযায়ী, বেবিচক ১৯৮২–৮৩ সালে কার্গো কমপ্লেক্সের দায়িত্ব বিমানের হাতে হস্তান্তর করে। পরে নিয়ম ভেঙে এর একটি অংশ আইএইএবির কাছে সাবলিজ দেওয়া হয়। এটি পরবর্তীতে 'কুরিয়ার বিল্ডিং' নামে পরিচিত হয়।

২০১৩ সালে সেখানে আগুন লাগে। এরপর বেবিচক ভবনটি পুনরুদ্ধার করে এবং ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আইএইএবিকে সরাসরি লিজ দেয়।

২০১৯ সালে আইএইএবি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়। লিজও ২০২৩ পর্যন্ত নবায়ন হয়নি।

অবশেষে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বেবিচক প্রত্যেক কুরিয়ার কোম্পানির সঙ্গে আলাদা লিজ চুক্তি করে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ভাড়াও সংগ্রহ করে।

এক বছর পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বেবিচক আবার আইএইএবির সঙ্গে যৌথ লিজ চুক্তি পুনঃস্থাপন করতে চায়। কিন্তু কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর চাপে তা বাতিল হয়।

২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আহমেদ জামিল বেবিচক চেয়ারম্যানকে চিঠি লেখেন।

চিঠিতে বলা হয়, জানুয়ারিতে সাত সদস্যের কমিটি বিমানবন্দরের উত্তর দিকে ২১ হাজার ৭৮০ বর্গফুটের পরিত্যক্ত আনসার ব্যারাকে সব "বিপজ্জনক পণ্য" সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সুপারিশ বাস্তবায়নে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তা জানা নেই।

কমিটি জানায়, বিমানবন্দর এলাকায় নতুন গুদাম নির্মাণের জায়গা নেই। তাই ওই পরিত্যক্ত ব্যারাকটিকে বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।