প্রাণবন্ত লেখার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

শহিদুল ইসলাম নিরব
শহিদুল ইসলাম নিরব
13 November 2025, 13:38 PM

বাংলা সাহিত্যে এমন লেখক খুব কমই আছেন, যিনি একইসঙ্গে পাঠককে হাসাতে ও কাঁদাতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই বিরল প্রতিভাবানদের একজন।

তার লেখায় উঠে আসে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিচ্ছবি। সাধারণ জীবনের ঘটনাগুলোও তার কলমে হয়ে ওঠে অসাধারণ। তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-সংগ্রাম যেমন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি দেখিয়েছেন বিত্তশালীদের মানসিক টানাপোড়েনও। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন জীবনের গল্পকার, যিনি সহজতাকে শিল্পে পরিণত করেছেন।

তার লেখার সবচেয়ে বড় শক্তি প্রাণবন্ততা। তার শব্দগুলো নিছক শব্দ নয়, যেন জীবন্ত চরিত্র—যারা কথা বলে, হাসে, কাঁদে। যেমন: 'হিমু'—হলুদ পোশাক পরা উদাস তরুণ, যে প্রমাণ করেছে পাগলামির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে গভীর প্রজ্ঞা। হিমু যেন শহরের ফুটপাথে হাঁটা এক নিঃশব্দ কবিতা, যে বলে, 'মানুষ সুখ খুঁজতে গিয়ে অসুখ পেয়ে বসে।' এক বাক্যে তিনি ধরেছেন জীবনের দর্শন, রসও।

তার লেখার ভাষা ছিল স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল। জটিল শব্দে কখনো জ্ঞানী সাজতে চাননি, বরং সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাতেই বলেছেন বড় বড় কথা।

তিনি লিখতেন এমনভাবে, যেন খুব কাছের কেউ আপনজনের মতো গল্প বলছে। 'শঙ্খনীল কারাগার'-এর বিষাদময় সংলাপ থেকে 'কোথাও কেউ নেই'-এর নিঃসঙ্গ শহর—সবখানেই বেজে ওঠে সেই মানবিক সুর।

'আপনি আমার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছেন, আমি আপনার জন্য জনম জনম কাঁদব।' তার এমন জাদুকরী লাইন আজও থমকে দেয় পাঠককে। সহজ ভাষায় জীবনের গল্প বলেই বই বিমুখ তরুণ-তরুণীকে সাহিত্য জগতে টেনে এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

তার রসবোধ ছিল স্বতন্ত্র। কখনো শিশুসুলভ সরলতায়, আবার কখনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ততায় তিনি সমাজের ভণ্ডামি তুলে ধরেন স্নেহময় কৌতুকে। 'বৃহন্নলা' বা 'পারুল ও প্রজাপতি' গল্পে যেমন সমাজের কুৎসিত বাস্তবতাকে কোমলভাবে মুড়ে দেন, যাতে পাঠক একইসঙ্গে হাসে ও অস্বস্তি বোধ করে। আবার 'এইসব দিনরাত্রি'র মফিজ চরিত্রে তিনি দেখান, বড় ঘটনার আড়ালে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিঃশব্দে বেঁচে থাকে।

তিনি ছিলেন সাহসী লেখক ও নির্মাতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে, যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল, তখন 'বহুব্রীহি' নাটকে টিয়াপাখির মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন 'তুই রাজাকার'।

হুমায়ূন আহমেদের উপমা ও রূপক ছিল অনন্য। 'তার মুখটা ছিল সকালবেলার দুধসাদা কুয়াশার মতো'—এমন এক লাইনেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরো দৃশ্য। আবার 'জীবন এক নদী, আমি স্রোতের ওপর ভাসমান একটি শুকনো পাতা'—এই বাক্যে যেমন আছে অসহায়তা, তেমনি আছে শান্তি।

তার চরিত্রগুলো ছিল খুব চেনা। 'মিসির আলি' যেমন যুক্তির প্রতীক—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক, যিনি সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, 'অযুক্তি মানেই অবিদ্যা, আর প্রকৃতিতে অবিদ্যার কোনো স্থান নেই।' আবার 'হিমু' ছিল রহস্যময়—যার কাছে কোনো যুক্তি কাজ করে না। শুভ্র চরিত্রটি যেন এক শুদ্ধ আত্মা, যে কলুষিত সমাজে নিজেকে শুদ্ধতায় মুড়ে রাখে।

নারী চরিত্রগুলোও হুমায়ূনের লেখায় গড়ে উঠেছে মমতায়। নবনী থেকে রূপা—সব চরিত্রই যেন সময়ের প্রতীক। তারা ভালোবাসে, হারায়, আবার ফিরে আসে।

গদ্যে ছিল কবিতার সুর। আলাদা করে কবিতা না লিখলেও প্রতিটি বাক্যে ফুটে উঠত ছন্দ। যেমন, 'নন্দিত নরকে' তিনি লিখেছেন, 'মানুষ মারা যায়, কিন্তু তার অভ্যাস মরে না।' ছোট্ট এই বাক্যে তুলে ধরেন তিনি চিরন্তন সত্য।

তিনি মূলত কবি হতে চেয়েছিলেন, জীবনানন্দ দাশের মতো। কিছুটা আফসোসও ছিল তার। 'শঙ্খনীল কারাগার'-এ তাই লিখেছেন—

দিতে পার একশ' ফানুস এনে,

আজন্ম সলজ্জ সাধ,

একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।

ম্যাজিক রিয়ালিস্ট লেখক ছিলেন। অলৌকিক গল্পগুলোও জীবনের রূপক। যেমন: 'দেয়াল' বা 'ঘেরা'য় তিনি দেখিয়েছেন ভয়, ভালোবাসা ও শূন্যতা কীভাবে বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। আবার 'ফিহা সমীকরণ'র মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতেও মানবিক অনুভূতি ছিল প্রবল।

বর্ণনা ছিল সিনেমাটিক। দৃশ্য যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত—বৃষ্টি, গ্রাম, শহরের নিঃসঙ্গ রাত, কিংবা ছেঁড়া খাতায় লেখা চিঠি। মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্না, স্বপ্ন-হতাশা—সবচেয়ে নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে তার লেখায়।

তিনি জানতেন, এই শ্রেণীই দেশের প্রাণ, সমাজের আয়না। তাই তার গল্পে আছে সাদামাটা জীবনের সৌন্দর্য—এক কাপ চা, কদম ফুল কিংবা জোছনা রাত।

সাহিত্যের বাইরে, নাটক-চলচ্চিত্রেও প্রাণ সঞ্চার করেন এই লেখক। 'কোথাও কেউ নেই'-এর বাকের ভাই চরিত্রের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে একসময় রাস্তায় নেমে এসেছিলো মানুষ—যা এক বিরল ঘটনা। তার নির্মিত নাটক 'আজ রবিবার', 'অয়োময়', 'বহুব্রীহি'—সবই ছিল দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে।

চলচ্চিত্রে 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'আমার আছে জল', 'শ্যামল ছায়া'—এসব ছবি কালজয়ী। স্বাধীনতার পর তিনি আবার দর্শকদের ফিরিয়ে এনেছিলেন সিনেমা হলে, পুনর্জীবিত করেন বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গন।

পাঠকের মনে জীবনের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন গল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয়—মানুষের হৃদয়ের লেখক তিনি।

তার কলমের জাদু এখনো মনে করিয়ে দেয় 'সূর্য অস্ত গেছে, কিন্তু আলো এখনো মাটিতে পড়ে আছে।'