বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে আইনে যা আছে

স্মৃতি মন্ডল
স্মৃতি মন্ডল
29 November 2025, 13:03 PM

বাংলাদেশে বিয়ে মানে কেবল দুটি মানুষের একসঙ্গে পথচলা নয়—এতে জড়িয়ে থাকে পরিবার, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ আর সামাজিক প্রত্যাশার দীর্ঘ পরম্পরা। কিন্তু সেই পথচলা কখনো কখনো ভেঙেও যায়, আর তখনই সামনে আসে বিচ্ছেদ–সংক্রান্ত নানান প্রশ্ন, সংশয় এবং আইনি জটিলতা।

বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদে আইনি প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান।

১. বাংলাদেশ আইন অনুযায়ী ইসলাম ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া কী

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪ এবং মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইন অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তালাক দিতে পারবে। তবে, স্বামীর সরাসরি তালাক দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও স্ত্রী স্বামীর থেকে তালাক-তাফওয়িজ বা আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার পান।

স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দেক না কেন মুসলিম ফ্যামিলি ল অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী তা লিখিতভাবে হতে হবে এবং স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল বা সিটি করপোরেশন অফিসে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান বা মেয়র সমঝোতার চেষ্টা করবেন। আপস-মীমাংসা না হলে নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিবাহিত হলে তালাক কার্যকর হয়।

২. ইসলাম ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদে পুরুষদের ক্ষেত্রে আইন

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী একজন মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। তবে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী তা লিখিতভাবে হতে হবে এবং স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল বা সিটি করপোরেশন অফিসে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান বা মেয়র সমঝোতার চেষ্টা করবেন। আপস-মীমাংসা না হলে নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিবাহিত হলে তালাক কার্যকর হয়।

৩. স্বামী তালাকের নোটিশ না পাঠিয়ে পুনরায় বিয়ে করলে আইনগত অবস্থা কী

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, মুসলিম পরিবার অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ধারা ৬ অনুযায়ী স্বামীকে আরবিট্রেশন কাউন্সিলের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনি শাস্তিযোগ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা (১০ হাজার টাকা পর্যন্ত) হতে পারে এবং দেনমোহর তাৎক্ষণিক পরিশোধ করতে হবে।

৪. ইসলাম ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদে নারীর ক্ষেত্রে আইন?

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ইসলাম ধর্মে নারীর জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের তিনটি পথ আছে। সেগুলো হলো—

তালাক-তাফওয়িজ: স্বামী নিকাহনামায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার প্রদান করলে স্ত্রী নিজেই তালাক দিতে পারেন।

খোলা তালাক: স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ।

আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি (ডিজোলিউশন অব মুসলিম ম্যারিজ অ্যাক্ট, ১৯৩৯): স্বামীর নির্যাতন, ভরণ-পোষণ না দেওয়া, দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকা ইত্যাদি কারণে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন।

৫. স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে সেক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদে আইন কী

ইসলামি শরীয়তে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন, এমনকি অন্তঃসত্ত্বাকালীনও। তবে স্ত্রীকে তার ইদ্দত পূর্ণ করতে হবে, যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হন, তবে ইদ্দত শেষ হবে সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। এক্ষেত্রে সন্তান জন্মের পর তালাক কার্যকর হবে। 

৬. ইদ্দতকালীন একজন মুসলিম স্ত্রীর অধিকার

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, স্ত্রী ইদ্দতের সময় স্বামীর কাছ থেকে ভরণ-পোষণের অধিকার রাখেন। অন্তঃসত্ত্বা হলে সন্তানের জন্ম পর্যন্ত। দেনমোহর, পাওনা সম্পদ ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

৭. হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদে আইনি প্রক্রিয়া কী

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রীয় আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে হিন্দু বিবাহ আইন, ২০১২ রয়েছে। এই আইনেও বিবাহ বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) সুযোগ নেই। তবে, দ্য হিন্দু ম্যারিড ওম্যান'স রাইট টু সেপারেট রেসিডেন্স অ্যান্ড ম্যাইন্টেন্যান্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ আইনে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু বিবাহিত নারীদের পৃথক বসবাস এবং ভরণপোষণ দাবির অধিকার দেওয়া হয়েছে।

৮. হিন্দু নারী কি পুনরায় বিয়ে করতে পারেন

শাস্ত্রীয় আইনে ও বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ আইন, ২০১২-তে ডিভোর্সের বিধান নেই। তবে, নারীরা স্বামীর মৃত্যু হলে পুনরায় বিয়ে করতে পারেন। ডিভোর্সের বিধান না থাকলেও আমাদের দেশে আদালতে আবেদনের মাধ্যমে ডিভোর্সের ঘোষণা পেয়ে হিন্দু নারী পুনরায় বিয়ে করার প্রচলন রয়েছে।

৯. খ্রিস্টান ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ আইন প্রক্রিয়া কী

বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের বিবাহবিচ্ছেদ ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯ অনুযায়ী হয়। এই আইনে ব্যভিচার, ধর্ম পরিবর্তন, নিষ্ঠুরতা, পরিত্যাগ ইত্যাদি কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করা যায়। আদালতের ডিক্রি ছাড়া খ্রিস্টানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয় না।

১০. বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করা দম্পতির বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া কী

বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করা দম্পতির স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সম্মতিতে আদালতে আবেদন করতে পারেন। অথবা এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যভিচার, ২ বছরের বেশি সময় আলাদা থাকা, নিষ্ঠুরতা, ডিজারশন ইত্যাদি কারণে আদালতে মামলা করে বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারবেন। বিবাহবিচ্ছেদ সম্পূর্ণভাবে আদালতের মাধ্যমে কার্যকর হয়।