‘ব্যাচেলর ভাড়া হবে না’ ঢাকার অতি পরিচিত বিড়ম্বনা
রাজধানীর যেকোনো এলাকায় বা গলিতে হেঁটে গেলে খুব সাধারণ একটি দৃশ্য চোখে পড়ে। সেটি হলো—দেয়ালে সাঁটা 'টু-লেট' বা বাসাভাড়ার বিজ্ঞপ্তি।
যেখানে একটি লাইন প্রতিবারই আলাদাভাবে চোখে পড়ে, 'ব্যাচেলরদের জন্য নয়'।
দেশের বিভিন্ন স্থানের তরুণ শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ পরিবার-পরিজন ফেলে শিক্ষা বা চাকরির সন্ধানে ঢাকা শহরে আসে। ঢাকা তাদের দু বাহু বাড়িয়ে স্বাগত জানালেও বাড়ির মালিক বা প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে সেটি বলা সম্ভব না। যে তরুণ পুরুষরা পরিবার ছাড়া এই শহরে থাকেন, তাদের জন্য ঢাকাজীবন সহজ নয়।
অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই ব্যাচেলর পুরুষদের কাছে তাদের অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে রাজি হন না। তাদের অভিযোগ, তরুণ বা ব্যাচেলর পুরুষরা ঝামেলা সৃষ্টি করেন, এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন হন, সময়মতো ভাড়া দেন না কিংবা ভবনের অন্য ভাড়াটিয়াদের বিরক্ত করতে পারেন।
আবার অনেক বাড়িওয়ালা ব্যাচেলরদের ভাড়া দিলেও মনে হয় যেন দয়া করছেন। আর এই দয়ার বিনিময়ে গুনতে হয় চড়া মূল্যের বাড়িভাড়া।
উদাহরণ হিসেবে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার কথাই ধরা যাক। ২০২৩ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরিত হওয়ার আগের দিনগুলোতে অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছেন এমন অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন, তারা ব্যাচেলর শিক্ষার্থী বলার সঙ্গে সঙ্গেই গেট থেকে গার্ড তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এই অস্বাভাবিকতার কথা উল্লেখ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্নাতক শিক্ষার্থী আফিফ রহমান বলেন, 'এখন সেই একই বাড়িওয়ালারা তাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য রিজার্ভ করে রাখছেন। তবে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায়।
তাও আবার এমন ফ্ল্যাট যেটিতে একটি মাত্র বাথরুম, মেঝেতে মোজাইক করা এবং যেখানে কোনো লিফটও নেই।'
ঢাকার বেশ কিছু এলাকার ব্যাচেলর পুরুষরা অভিযোগ করেছেন, পরিবার সঙ্গে থাকায় তাদের অন্যদের চেয়ে বেশি ভাড়া দিতে হয়।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির স্নাতক শিক্ষার্থী রিয়াদ উদ্দিন তার রুমমেটের সঙ্গে বাসা খোঁজার সংগ্রামের কথা বললেন।
তিনি বলেন, 'কয়েক মাস আগে যখন আমি সাধ্যের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছিলাম, তখন প্রায় সব অ্যাপার্টমেন্টই ছিল মেয়েদের বা পরিবারের জন্য।'
'যে অল্প কয়েকজন বাড়িওয়ালা আমাদের তাদের ভবনে ঢুকতে দিতে রাজি ছিলেন, তারা অত্যন্ত উচ্চ ভাড়া এবং ইউটিলিটি ফি দাবি করছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন ঢাকায় ব্যাচেলর পুরুষ হিসেবে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার জন্য আমাদের অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে।'
অযৌক্তিক পরিমাণে ভাড়া দিয়ে যারা কোনোমতে একটি জায়গা খুঁজে পান তারা অনেক সময় আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য ব্যাচেলরদের সঙ্গে সাবলেট হিসেবে কাউকে নেন। কিন্তু তারপরেও দুর্দশার শেষ হয় না।
অনেক ব্যাচেলর পুরুষ অভিযোগ করেন, তারা পরিবারসহ যারা থাকেন তাদের মতো একই স্বাধীনতা ও সম্মান পান না।
স্নাতক শিক্ষার্থী দেবজ্যোতি মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন, 'আমরাও অন্যদের মতো ভাড়া দিই। কিন্তু সেই স্বাধীনতা পাই না যা অন্য ভাড়াটিয়ারা পায়। মাঝে মাঝে জরুরি প্রয়োজন থাকলেও বাসায় ঢোকার সময় নিয়ে ক্রমাগত সতর্কবার্তা শুনতে হয়। আমরা খুব ভালোভাবে থাকলেও হঠাৎ করেই কোনো কারণ না দেখিয়েই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের পছন্দের ইন্টারনেট প্রোভাইডারও বেছে নিতে পারি না। সেটাও বাড়িওয়ালার কথার ওপর নির্ভর করে!'
চাকরিজীবী মো. হাদিউল ইসলাম পূর্ণ মৃধা ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে সাবলেট থাকেন। কাজ এবং ব্যাচেলরজীবন সামলাতে গিয়ে প্রায়ই তাকে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, 'ভাড়ার আড়ালে অতিরিক্ত টাকা দিলেও, ভাড়াটিয়া হিসেবে আমাদের কোনো সন্তুষ্টি নেই। বাড়ির মালিকেরা ছাদের ব্যবহার, মূল ফটকের চাবি এবং এমনকি সময়মতো পানি পাওয়ার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোতেও বাধা দেন।'
অবশ্য এখানেই সংগ্রামের শেষ নয়।
পরিবার থেকে দূরে থাকা তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। যা একজন শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীর দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী সৈয়দ ফারহান বলেন, 'যখন আপনি পরিবারের সঙ্গে থাকেন, তখন মাঝরাতে ফ্রিজ খুলে অন্তত কিছু খাবার খুঁজতে পারেন। কিন্তু সাবলেট অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে রাতের একাকীত্ব সবচেয়ে বেশি পোড়ায়। যখন প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ফ্রিজ খুলে আপনি দেখতে পান সেখানে খাওয়ার মতো কিছু নেই।'
আফিফ রহমানের মতে, এটি আপনাকে ঢাকা শহরে থাকার কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে হাতে-কলমে ধারণা দেয়। এটা এমন এক বাস্তবতা, মনে হয় কেউ বুঝি পেটে ঘুষি মারছে!
'উদাহরণস্বরূপ, যদি আমি মুদি সামগ্রীতে ১৫ হাজার টাকা এবং ভাড়া ও ইউটিলিটিতে আরও ১০ হাজার টাকা খরচ করি, তবে আমি জানি যে এই শহরে কেবল বেঁচে থাকার জন্য আমাকে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করতে হবে! আর যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে আমি একা।'
অবশ্য এর মধ্যেও কেউ কেউ ঢাকাজীবনের ভালো দিকটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
নিজের জীবনের কথা ভেবে আফিফ বলেন, 'পরিবার থেকে দূরে একা থাকায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঠগুলো দ্রুত শিখে নেওয়া যায়। পরিবারের সঙ্গে থাকলে হয়তো শিখতে পারতাম না। এটি একজন ব্যক্তিকে তার বয়সের চেয়ে বেশি পরিণত করে তোলে।'
অনুবাদ করেছেন জ্যোতি রশীদ


