ঢাকা শহরের নব্বই দশকের বেকারিগুলো

নাদিয়া রহমান
নাদিয়া রহমান
1 December 2025, 15:19 PM
গরম ওভেন থেকে আসা পাউরুটি, বাটার বিস্কুট আর ক্রিম রোলের সেই গন্ধ যেন জানিয়ে দিত সময়টা ধীরে বয়ে যাচ্ছে, শহরটা তখনো ব্যস্ত হয়নি এতটা।

একসময় ঢাকার সকাল শুরু হতো রুটির গন্ধে, আর বিকেল শেষ হতো কেকের মিষ্টি স্বাদে। সেই সময়ের ঢাকাকে আজও মনে করিয়ে দেয় কয়েকটি নাম—চট্টলা, ডিসেন্ট, স্টার, সুইস আর আনন্দ বেকারি। গরম ওভেন থেকে আসা পাউরুটি, বাটার বিস্কুট আর ক্রিম রোলের সেই গন্ধ যেন জানিয়ে দিত সময়টা ধীরে বয়ে যাচ্ছে, শহরটা তখনো ব্যস্ত হয়নি এতটা। তখন হাতেগোনা এই কয়টি বেকারিই ছিল পরিচিত। হয়তো একতলা চট্টলা বেকারি দিয়ে চিনিয়ে দেওয়া হতো—ধানমন্ডি ৮/এ সড়কের কথা বলছি।

চট্টলা বেকারি ছিল পুরোনো ঢাকার প্রাণের জায়গা। তবে ধানমন্ডি ৮/এ সড়কে আমার মনে পরে একতলার সেই নানান চানাচুর, বিস্কিট, কেক সাজিয়ে রাখা একটু অবিন্যস্ত কিন্তু অনেক কিছু রাখা সেই দোকানটি। বাবা সরকারি অফিস শেষে বিকেলে ঘরে ফেরার সময় চট্টলা থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আসতেন। আমার আগ্রহ থাকতো সেই প্যাকেট ঘিরে, কী আছে এর ভেতর। কেকজাতীয় কিছু হলে আমি খুশি হতাম, সিঙ্গারা, ভাঁজাপোড়া থাকলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠত। সে বয়সে এসব খাবার ভাল লাগতো না।

অন্যদিকে সুইস বেকারি ছিল ঢাকার প্রথমদিককার পরিশীলিত বেকারিগুলোর একটি। তাদের দোকানে ঢুকলেই বোঝা যেত যে এখানে একটু ভিন্ন কিছু আছে, এবং সেটা পশ্চিমা ধাঁচের। কাচের শোকেসে সাজানো ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক,  বাটার স্পঞ্জ, এগ পাফ বা ছোট কেকের টুকরো—সবকিছুতেই ছিল একরকম ইউরোপিয়ান ছোঁয়া। নব্বইয়ের দশকে জন্মদিনের পার্টিতে যদি কেকের বাক্সে 'সুইস বেকারি' লেখা না থাকত, তাহলে যেন উৎসবটাই অসম্পূর্ণ মনে হতো। আর সে সময় জন্মদিনে কেক আনা নিয়েও থাকতো পরিবারের বড়দের কত শর্ত! 'পরীক্ষায় এবার প্রথম না হলে কেক আনা হবে না', 'এবারটায় অংকে ৮০'র বেশি কম পেলে কোনো জন্মদিন উদযাপন হবে না', ইত্যাদি!

এরপর আসে আবাহনী মাঠটা পেরিয়ে সামনে হেঁটে গেলে, আরেক জনপ্রিয় কাবাবের দোকান লা-বাম্বা'র ঠিক এক-দুটো দোকান পাশেই ডিসেন্ট বেকারি। সুইস বেকারির চেয়ে দামে কিছুটা সহজলভ্য, তবে ডিসেন্টের এই চেরি দেওয়া, ফ্রস্টেড ক্রিম দেওয়া প্যাস্ট্রি, কিংবা চিকেনের পুর দেওয়া প্যাটিজও ঘরে আনা হতো কালেভদ্রে। যেদিন ঘরে কোনো মেহমান আসবে, সেই মেহমান হয়তো সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছেন। কিংবা ঘরে আমরা কেউ আকস্মিকভাবে পরীক্ষায় ভালো করে ফেলেছি, সেই খুশিতে বাবা ডিসেন্ট থেকে চকোলেট প্যাস্ট্রি আর সেই চিকেনের পুর দেওয়া প্যাটিজ আনতেন। আনার সঙ্গে সঙ্গেই কাগজের বাক্স খালি। পরে যখন ৯০ দশকের পর এই শহরের মানুষের জীবনযাত্রা বদলালো, ফ্রস্টেড ক্রিম দেওয়া ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক মানেই শুধু পশ্চিমা সুস্বাদু কোনো খাবার নয়, তখন ডিসেন্টের এই কাগজের বাক্সের আনাগোনা কিছুটা বেড়ে গেল ঘরে।

অবশেষে স্টার কাবাব আর বেকারি। এর কথা না বললেই না। এখনো কাবাব, দেশীয় খাবার, ফালুদা'র জন্যও বেশ জনপ্রিয় এই রেস্তোরাঁ এবং তাদের বেকারি। ধানমন্ডি, গ্রীনরোড, উত্তরায় তাদের শাখাগুলোয় সবসময়ই ছিল ভিড়। স্টার আসলে ঢাকায় 'প্রিমিয়াম বেকারি' সংস্কৃতি শুরু করেছিল। সেই সময়ে কোনো দাওয়াত বা উদযাপন মানে স্টার থেকে আনা নান রুটি আর গরম শিক কাবাব। সঙ্গে এই বেকারির চিকেন প্যাটিজ, নয়তো ফ্রুট কেক। স্টার থেকে কেক বা রুটি কেনা একসময় ছিল বিশ্বস্ততার ব্যাপার, যেন বলার মতো কিছু, 'এটা স্টারের'।

আর হ্যাঁ, ভুলে গেলে চলবে না আনন্দ বেকারির কথা। নামের মতোই আনন্দ ছড়িয়ে দিত তারা তাদের খাবারে। তাদের ছোট কেক, নারকেল বিস্কুট, পাউরুটি বা মিষ্টি রোল ছিল স্কুলছাত্র থেকে অফিসকর্মী, অধিকাংশের নাগালের মধ্যে।

আজকের ঢাকায় হয়তো স্টার বা সুইসের পুরোনো শাখাগুলো টিকে আছে কোথাও কোথাও, আবার কিছু হয়তো সময়ের ভিড়ে মিশে গেছে। কিন্তু তাদের নাম, গন্ধ আর স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে ঢাকার বাতাসে। যেন সকালবেলার এক মৃদু সুবাস, যা বলে দেয়, একসময় যানজট, পিপীলিকার মতো মানুষের সারিবিহীন এই শহর কেমন ছিল!