আসাদের পতনের ১ বছর: এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি সিরিয়া

মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
9 December 2025, 06:45 AM
UPDATED 9 December 2025, 14:07 PM

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, মোহাম্মাদ মারওয়ান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার থেকে খালি পায়ে, দুর্বল ভঙ্গীতে বের হয়ে আসেন।

তৎকালীন স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতনের পর মারওয়ানের মতো আরও অনেক সিরিয় নাগরিক দুঃখ, দুর্দশা ও শোষণ থেকে মুক্তি পান। বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্ত করে দেয়। 

তবে আসাদের পতনের এক বছর পরও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি সিরিয়া।

বাশার আল আসাদের পতনের বর্ষপূর্তিতে এপি, রয়টার্স, আল জাজিরা ও বিবিসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

সিরিয়ার দ্বিতীয় স্বাধীনতা 

চলতি বছরের অক্টোবরে সিরিয়ার বর্তমান শাসক আহমেদ আল শারা ৮ ডিসেম্বরকে 'স্বাধীনতা দিবস' আখ্যা দেন। এই দিনটি সিরিয়ায় সরকারি ছুটির দিন এবং এ দিনে ছুটি কাটালেও কর্মীরা পূর্ণ বেতন পাবেন।

দিবসটিকে 'বাথ-পন্থি জাতীয়তাবাদী শাসনের' অবসান দিবস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে দিনটি উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছিল বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের জোট।

Syria
আসাদ সরকার পতনের এক বছর পূর্তিতে উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

দীর্ঘ ছয় বছর বিনা বিচারে আটক থাকার পর ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার 'দ্বিতীয় স্বাধীনতার' স্বাদ পেয়ে অন্য আরও অনেকের মতো মারওয়ানও মুক্তি পান।

মুক্তির পর হোমস প্রদেশে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্যে স্বাধীন দিনগুলো ভালোই কাটাচ্ছিলেন মারওয়ান।

কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি।

দীর্ঘ কারাবাসের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খান তিনি। বুকে ব্যথা, নিশ্বাসে সমস্যা, উদ্বেগ ও অনিদ্রার মতো ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। সেরে উঠতে পারছেন না কোনো ভাবেই।

আপাতত যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন মারওয়ান। পাশাপাশি, সাবেক কারাবন্দীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে আয়োজিত থেরাপিতেও অংশ নিচ্ছেন তিনি।

'সেরে উঠতে' হিমশিম খাচ্ছে সিরিয়াও

মারওয়ানের মতো সিরিয়াও দীর্ঘ দিনের অপশাসন, শোষণ ও দুর্নীতির গ্রাস থেকে 'সেরে উঠতে' হিমশিম খাচ্ছে।

আসাদ পরিবারের ৫০ বছরের একনায়কসূলভ শাসন ও সংশ্লিষ্ট ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের মানুষের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি।

Syria
বাশার পরবর্তী এক বছরেও বদলেনি সিরিয়া। ছবি: রয়টার্স

এসব সংঘাতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। লাখো মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

আসাদের 'আকস্মিক' পতন অনেকের বিস্ময়ের কারণ। এমন কী, বিদ্রোহী-বিপ্লবীদের একাংশের কাছেও বিষয়টি অবিশ্বাস্য ছিল। ২০২৪ সালের নভেম্বরে হায়াত তাহরির আল-শাম নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আলেপ্পো শহরে আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়।

অবাক করা বিষয় হলো, তেমন কোনো প্রতিরোধ না গড়েই সিরিয়ার সরকারি বাহিনী পরাস্ত হয়। শুরুতে আলেপ্পো, তারপর গুরুত্বপূর্ণ শহর হামা ও হোমস এর পতন হয় বিদ্রোহী নেতা আহমাদ আল-শারা'র নেতৃত্বে।

অল্প সময়ের মধ্যে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিলেও আহমাদ আল-শারার সরকার এখনো বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছে। অপ্রত্যাশিত বিজয়ের ভারে শাসকগোষ্ঠীও হিমশিম খাচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মত দেন।

পররাষ্ট্রনীতিতে সফল

বিদ্রোহীদের নেতা আহমেদ আল শারা সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরিতে মনোযোগ দেন আল শারা।

বিশেষত, যেসব দেশ আসাদকে একঘরে করে রেখেছিল এবং আল শারাকে জঙ্গি আখ্যা দিয়েছিল, তাদের সঙ্গে যেচে পড়ে আলোচনা ও কূটনীতিক সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

Ahmed Al Sharaa
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আল-শারা। ছবি: রয়টার্স

নভেম্বরে 'বিশেষ সাফল্য' অর্জন করেন আল-শারা।

১৯৪৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সিরিয়ার প্রথম শাসক হিসেবে ওয়াশিংটন সফর করেন তিনি। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার রসালো আলাপ পত্রিকার শিরোনাম হয়।

আল-শারাকে জঙ্গি সদস্যের তালিকা থেকে বাদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর সিরিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন ট্রাম্প। তবে সাবেক শাসক আসাদ, তার পরিবারের সদস্য ও সমর্থক, আইসিসি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ইরানের সহযোগী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়নি।

আরব দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো হয়েছে সিরিয়ার।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত রিয়াদ সম্মেলনে সিরিয়াকে আরব লিগে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত অনুমোদন পায়। সে সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেন আল-শারা। সৌদি সরকারের কাছ থেকে পুনর্নিমাণের জন্য এক বিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন তিনি।

Syria
আসাদ সরকার পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বক্তব্য রাখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। ছবি: রয়টার্স

কাতার ও মিশরের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালান আল-শারা। তিনি সিরিয়াকে 'স্থিতিশীলতার মডেল' হিসেবে তুলে ধরেন।

একই মাসে ইরানকে 'কৌশলগত হুমকি' আখ্যা দিয়ে ইরান-সমর্থিত আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সিরিয়া থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন আল-শারা। তাদের মধ্যে সিরিয়ার ভূখণ্ডে অবস্থানরত হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেন।

তবে আল-শারার কূটনীতিক সাফল্যকে ছাপিয়ে গেছে দেশের ভেতরের নানা সমস্যা।

গোত্রে গোত্রে সংঘাত

গত এক বছরে, সরকারপন্থি সুন্নি যোদ্ধাদের হাতে দ্রুজ ও আলাবি নৃগোষ্ঠীর হাজারো বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গোত্রে গোত্রে সংঘাত এখন দেশটির নিত্যদিনের ঘটনা।

দক্ষিণের সোওয়েইদা প্রদেশের স্থানীয় দ্রুজ গোত্রগুলো এখন তাদের নিজেদের মতো করে স্বতন্ত্র প্রশাসন গড়ে তুলেছে। তারা আল শারার কেন্দ্রীয় শাসন মানতে রাজি নন। আল শারা নিজেও তাদেরকে খুব একটা ঘাটাতে আগ্রহী নন।

Syria
সিরিয়ার দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদযাপন করছে সেনারা। ছবি: রয়টার্স

পাশাপাশি, দামেস্কের নতুন সরকার ও দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুর্দি নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনীর মধ্যে আদর্শগত সংঘাত ও অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

মার্চে ওই বাহিনীর সদস্যদের মূল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

দ্রুজদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে এসেছে ইসরায়েল। গত এক বছরে জঙ্গি কার্যক্রমে রাশ টেনে ধরা' ও দ্রুজদের সুরক্ষা দেওয়ার অজুহাতে 'স্বাধীন' সিরিয়ায় একাধিকবার হামলা চালিয়েছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সেনা।

ইসরায়েলি হুমকি

সিরিয়ার নতুন শাসকদের 'ইসলামপন্থি' আখ্যা দিয়েছে গাজায় গণহত্যা চালানো দেশ ইসরায়েল। তবে আল-শারা বলেছেন, তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে কোন সংঘাতে যেতে চান না।

তা সত্ত্বেও, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে তেল আবিব। পাশাপাশি, আসাদের পতনের পর নিয়মিত সিরিয় ভূখণ্ডে অভিযান ও বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সেনা। দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে দরকষাকষিও স্থবির হয়ে পড়েছে।

ইরান ও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিন্দা করে ইসরায়েলের নিরব সমর্থন জুটিয়েছেন আল-শারা। তবে এখনো 'ইসরায়েলের বন্ধু' হতে পারেনি সিরিয়া।

যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি অধ্যুষিত ক্ষমতাধর দেশটি নিরন্তর ঝুঁকি হিসেবে সিরিয়দের মাথা ব্যথার কারণ।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তথৈবচ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে বাশার আল-আসাদের শাসনামলে সিরিয়ার ওপর আরোপ করা অর্থনৈতিক বিধিনিষেধগুলো একে একে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তা সত্ত্বেও, সিরিয়ার অর্থনীতি গতিশীল হতে পারেনি।

Syria
সিরিয়ার দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদযাপন। ছবি: রয়টার্স

উপসাগরীয় দেশগুলো পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগের অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। আসেনি বিন সালমানের প্রতিশ্রুত

বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব মতে, বহু বছরের সংঘাতে জর্জরিত সিরিয়ার পুনর্নির্মাণে কমপক্ষে ২১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

এখন পর্যন্ত পুনর্নির্মাণের উদ্যোগগুলো খুবই ছোট পর্যায়ের। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে তাদের নিজ বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিধ্বস্ত ভবনগুলো মেরামত করে নিয়েছেন।

আগের তুলনায় ভালো, তবে…

দামেস্কের দন্ত চিকিৎসক বাসাম দিমাশকি এপিকে বলেন, 'অবশ্যই দেশ এখন আগের চেয়ে ভালো আছে। আমরা এক প্রকারের স্বাধীনতা উপভোগ করছি।

তবে দেশের ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও অর্থনীতির দুরবস্থা নিয়ে উদ্বেগে আছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে বাকি সব কিছু এমনিতেই অর্জন হবে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো হলেই বিনিয়োগকারী আসবে এবং নতুন নতুন প্রকল্প চালু হবে।

Syria
সিরিয়ার দুই নারী ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছেন। ছবি: রয়টার্স

সাবেক বন্দি মারওয়ান দাবি করেন, বর্তমান সিরিয়ার সঙ্গে আসাদের আমলের সিরিয়ার 'আকাশ পাতাল ব্যবধান।'

তবে তিনি স্বীকার করেন, দেশ এবং তিনি নিজে আর্থিক সমস্যায় ধুঁকছেন।

স্থায়ী কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। সপ্তাহের কোনো দিনে হয়তো ৫০ বা ৬০ হাজার সিরিয় পাউন্ডের একটি কাজ জোটাতে পারেন তিনি। কোনো কোনোদিন সেটুকুও আয় করতে পারেন না।

উল্লেখ্য, ৫০ হাজার সিরিয় পাউন্ডের মূল্যমান প্রায় পাঁচ ডলারের সমান।

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা শেষ হলে তিনি লেবাননে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে জানান।

'সেখানে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে', যোগ করেন মারওয়ান।