হন্ডুরাসের নির্বাচনে কেন ফিলিস্তিন-বংশোদ্ভূত প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন ট্রাম্প?
মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাস। সেখানে এখন ভোররাত। সকাল হলেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেই নির্বাচনে তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর একজন নাসরি আসফুরা। দেশটির ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল পার্টির সভাপতি এই প্রার্থী ফিলিস্তিন-বংশোদ্ভূত। ১৯৪০ এর দশকে আরব-ইহুদি সংঘাত এড়াতে তার পরিবারের সদস্যরা হন্ডুরাসে পাড়ি জমায়।
ধনকুবের আসফুরার বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ। ২০২০ সালে হন্ডুরাসের আদালত তার বিরুদ্ধে রায় দেয়। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ২০২১ সালে তার নাম পানামা পেপারসে আসে। পরে তাকে সব অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প হন্ডুরাসের প্রভাবশালী এই আবাসন ব্যবসায়ীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ায় নাসরি আসফুরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন।
গতকাল শনিবার সিএনএন-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—ট্রাম্পের প্রভাব ও প্রতারণার অভিযোগের মধ্যে হন্ডুরাসবাসী নির্বাচনে যাচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে—হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুচিগালপার সাবেক মেয়র, ব্যবসায়ী ও ডানপন্থি ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী নাসরি আসফুরা মুক্তবাজার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। তাকে সমর্থন দিয়েছেন অপর আবাসন ব্যবসায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প।
গতকাল ভোরে ট্রাম্প তার নিজস্ব সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেন, 'প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হন্ডুরাসে গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।' দীর্ঘ পোস্টে ট্রাম্প প্রশ্ন রাখেন—কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো হন্ডুরাসও কি মাদক চোরাকারবারিদের হাতে চলে যাবে?
ট্রাম্পের মতে—গণতন্ত্রের পক্ষে এবং ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি মাদুরোর বিপক্ষে যে ব্যক্তি দাঁড়াতে পারেন তিনি হচ্ছেন হন্ডুরাসের ন্যাশনাল পার্টির নাসরি আসফুরা। তিনি তার বার্তায় তেগুচিগালপার মেয়র থাকার সময় আসফুরার সাফল্য তুলে ধরে বলেন, এই প্রার্থী নগরীর লাখো বাসিন্দার পানির সমস্যা মেটানোর পাশাপাশি শত শত কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছিলেন।
ট্রাম্পের চোখে আসফুরার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও বামপন্থি লিবরে পার্টির প্রার্থী দেশটির প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও আইনজীবী রিক্সি মনকাদা। হন্ডুরাসের বর্তমান রাষ্ট্রপতি বামপন্থি নেতা শিয়োমারা কাস্ত্রো এই প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। মনকাদা তার দেশের বর্তমান নেতার নীতিগুলো মেনে চলবেন বলেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ঘোষণা দিয়েছেন।
মনকাদা কিউবার সাবেক নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে তার আদর্শ হিসেবে মানেন। তাই মার্কিন রাষ্ট্রপতির আশা, হন্ডুরাসের জনগণ মনকাদাকে প্রত্যাখ্যান করবে। তারা আসফুরাকে নির্বাচিত করবে। কিন্তু, তাতেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না ট্রাম্প। হন্ডুরাসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এপাশ-ওপাশ দেখিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বলছেন, 'কিন্তু, কমিউনিস্টরা কৌশল হিসেবে সালভাদর নাসরাল্লাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।' নাসরাল্লাকে 'স্বাধীনতাবিরোধী' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি মনে করেন, আসফুরার ভোট কাটার জন্য নাসরাল্লাকে প্রার্থী করা হয়েছে।
ট্রাম্প আরও মনে করেন, নাসরাল্লা কমিউনিস্টবিরোধী ভাব নিলেও আসলে তিনি একজন 'প্রায় কমিউনিস্ট'। ট্রাম্পের পছন্দের প্রার্থী আসফুরাকে হারাতে নাসরাল্লাকে নির্বাচনে প্রার্থী করানো হয়েছে।
সিএনএন-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—আগামী ২৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শিয়োমারা কাস্ত্রো তার মেয়াদ পূরণ করতে পারলে হন্ডুরাসের ইতিহাসে প্রথম কোনো বামপন্থি দল পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস গড়বে। এই বামপন্থি নেতার স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি মানুয়েল জেলায়াকে ২০০৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদন অনুসারে—শিয়োমারা কাস্ত্রোর শাসনামলে হন্ডুরাসের অর্থনীতিতে কিছুটা চাঙা-ভাব দেখা গিয়েছে। তিনি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচিও চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ২৭ নভেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে হন্ডুরাসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শীর্ষ প্রার্থীদের তথ্য তুলে ধরা হয়। কয়েকটি জনজরিপের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে তিনজন বেশি জনপ্রিয়। তারা হচ্ছেন—ক্ষমতাসীন লিবার্টি অ্যান্ড রিফাউন্ডেশন পার্টির ৬০ বছর বয়সী রিক্সি মনকাদা, ন্যাশনাল পার্টির ৬৭ বছর বয়সী নাসরি আসফুরা ও লিবারেল পার্টির ৭২ বছর বয়সী সালভাদর নাসরাল্লা।
কিন্তু, ট্রাম্প চান এসব প্রার্থীর মধ্যে ফিলিস্তিন-বংশোদ্ভূত আসফুরা জিতে আসুক। তিনি চান তার সঙ্গে মিলেমিশে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে। তিনি আসফুরার মাধ্যমে অভাবগ্রস্ত হন্ডুরাসবাসীর কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে চান।
গুয়েতেমালা, নিকারাগুয়া ও এল সালভাদরের প্রতিবেশী হন্ডুরাসের আয়তন ১ লাখ ১২ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। দেশটির জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখের কাছাকাছি। হন্ডুরাসের সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০২৩ সালে সেখানকার জনগণের ৬৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছিল।
ট্রাম্পের ভাষ্য, 'আমি মনকাদা ও কমিউনিস্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারবন না। নাসরাল্লাকে বিশ্বাস করা যায় না। সে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য নির্ভরযোগ্য লোক নয়। আমি আশা করি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য হন্ডুরাসের মানুষ আসফুরাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবে।'
ধারণা করা যায়, উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলাকে 'শায়েস্তা' করতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প মধ্য আমেরিকায় মিত্র খুঁজছেন। আর সে জন্যই তার প্রয়োজন হন্ডুরাসের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। এর জন্যই নাসরি আসফুরাকে হন্ডুরাসের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রয়োজন।