সুদানের গৃহযুদ্ধ: দুই ‘বন্ধুর’ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘাত
সুদানে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এই সংঘাতে হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। এই সংঘাতের পেছনে স্বাধীনতা অর্জন, বৈষম্য দূরীকরণ বা শোষকের হাত থেকে মুক্তি—এ ধরনের কোনো কারণ নেই। দুই জেনারেলের ব্যক্তিগত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই মূলত এই 'নারকীয়' পরিস্থিতির জন্ম।
২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান-এর নেতৃত্বাধীন সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) বিরুদ্ধে লড়ছে তারই এক কালের সহযোগী ও 'বন্ধু' মোহামেদ হামদান 'হেমেতি' দাগালো-এর আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, এই সংঘাতে দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি মানুষ। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ।
যেভাবে সংঘাতের শুরু
৩০ বছর সুদানের ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল সেনাবাহিনী এসএএফ ও আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফের দুই প্রধান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৎকালীন একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে বশিরের বিরুদ্ধে গোটা সুদানজুড়ে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ ও তা থেকে সৃষ্ট গোলযোগের সুযোগ নিয়ে ক্যুর মাধ্যমে বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন বুরহান ও দাগালো।
একনায়ক বশিরের পতনের পর, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক কাউন্সিলের (টিএমসি) নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান জেনারেল বুরহান। তার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন আরএসএফ প্রধান দাগালো।
এক পর্যায়ে নতুন করে দেশে বেসামরিক সরকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়।
২০১৯ এর ৩ জুন 'খার্তুম গণহত্যা' নামে পরিচিত দমন-পীড়নমূলক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকামী জনগণের স্বপ্নকে দমিয়ে দেন দুই বন্ধু।
তবে ওই বছরের আগস্টে বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে একটি ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার চুক্তিতে সই দেন তারা।
কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আবারো ক্যু ঘটান দাগালো ও বুরহান। এবার বেসামরিক সরকার ভেঙে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদককে গ্রেপ্তার করেন তারা।
এবার নতুন একটি 'সার্বভৌম কাউন্সিল' গঠন করে বুরহান-দাগালো যথাক্রমে সরকার প্রধান ও উপপ্রধানের দায়িত্ব নেন।
তখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছিল, সেনা শাসন অব্যাহত থাকলেও অন্তত সুদানে শান্তি ফিরেছে। ফিরেছে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা। কিন্তু সেই সুদিন বেশিদিন টেকেনি।
অস্থিরতার শুরু
সামরিক কাউন্সিলের ওপর জাতিসংঘের বেধে দেওয়া কাঠামো মেনে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার চাপ আসতে থাকে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
ওই কাঠামোর মূলে ছিল আরএসএফকে মূল সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশনা।
২০২২ থেকে ২০২৩ এর শুরু পর্যন্ত এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে।
জাতিসংঘের এই শর্ত আরএসএফ প্রধান দাগালোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। তিনি ধরে নেন, তার বাহিনী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলে দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ও ব্যক্তিগত ক্ষমতা হারাবেন তিনি।
বন্ধুত্বে ফাটল ও বৈরিতা
আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূতকরণের প্রতিবাদে ২০২৩ সালের এপ্রিলে রাজধানী খার্তুমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে আরএসএফ।
সে সময় থেকে দুই সাবেক মিত্র ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রূপ নেয় এক নির্মম, সহিংস ও মর্মান্তিক গৃহযুদ্ধে।
বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'ক্যুর সময় তারা দুইজন ভাইয়ের মতো ছিলেন। কিন্তু এক ভাই পরবর্তীতে আরেক ভাইয়ের দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে ধরেন।'
আল জাজিরার প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, '২০২১ সালের ক্যুর সময় যে দুইজন ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন, তারাই পরিণত হলেন একে অপরের চিরশত্রুতে। আর এভাবেই বুরহান ও হেমেতির সম্পর্কে ফাটল ধরল।'
২০২৩ সালের এপ্রিলে রয়টার্সের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'এককালে ক্ষমতার অংশীদার থেকে সুদানের দুই জেনারেল এখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।'
বর্তমান পরিস্থিতি
২০২৩ এর এপ্রিলে যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল-হামাস বা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো সুদানের যুদ্ধেও বেশ কয়েকবার বিরতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন মহল। ২৪ ঘণ্টা, তিন দিন, সাত দিনের মতো ছোট ছোট সময়কাল ধরে যুদ্ধে বিরতি আসলেও স্থায়ী বিরতি বা কোনো পক্ষের নিরঙ্কুশ বিজয়ের কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
সুদানের পশ্চিমে অবস্থিত উত্তর দারফুর অঙ্গরাজ্যের রাজধানী এল-ফাশের ছিল সুদানি সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি। ১৮ মাসের অবরোধের পর গত রোববার আরএসএফ শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই ঘটনাকে চলমান যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
দারফুরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে দাগালোর আরএসএফ।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ওই এলাকার দখল নেওয়ার পর আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে।
সুদানের সামাজিক কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সালমা ইশাকের বরাত দিয়ে আজ রোববার মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, এল-ফাশেরে প্রবেশের পর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দাগালোর সেনারা ৩০০ নারীকে হত্যা করেছেন।
গত বুধবার রাতে আরএসএফ প্রধান মোহাম্মদ হামদান 'হেমেতি' দাগালো তার যোদ্ধাদের বেসামরিক মানুষকে রক্ষার নির্দেশ দেন এবং বলেন, 'অপরাধীরা শাস্তি পাবে।'
বৃহস্পতিবার আরএসএফ জানায়, তারা কিছু অপরাধী যোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার আরএসএফের এই তদন্তের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।
সুদানের সংঘর্ষ চলাকালে সেনাবাহিনী ও আরএসএফ উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, এ পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ নিহত, প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়েছে। দুর্ভিক্ষ ও মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
শনিবার যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা এক যৌথ বিবৃতিতে অবিলম্বে সুদানের যুদ্ধবিরতি চালুর আহ্বান জানান।
দারফুরে নৃশংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা এই বিবৃতি দেন।
বাহরাইনের রাজধানী মানামায় এক নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় মন্ত্রীরা বলেন, তারা সুদানে আরএসএফ সংঘটিত 'ভয়াবহ' ঘটনাগুলোর প্রতি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন।
সুদানের সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, এল-ফাশেরের এক হাসপাতালে আরএসএফের যোদ্ধারা হামলা চালালে ৪৫০ জন নিহত হন। পাশাপাশি, গণফাঁসি ও ধর্ষণের অভিযোগও এসেছে আধা-সামরিক বাহিনীর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।
আএরএসএফ হাসপাতালে হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছে।
তবে সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া স্যাটেলাইট ছবি ও শহর থেকে পালিয়ে আসা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে এল-ফাশেরে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গাজার যুদ্ধের রেশ না কাটতেই সুদানের এসব সাম্প্রতিক সহিংসতা বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করেছে। বিশ্বজুড়ে সুদানে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
হয়তো এবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এগিয়ে আসতে হবে কোনো শান্তি ফর্মুলা নিয়ে।


