শীতেও কেন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে?

হেলিমুল আলম
হেলিমুল আলম
13 December 2025, 06:14 AM

একসময় ডেঙ্গুকে শুধু বর্ষাকালের রোগ হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু সেই ধারণা এখন বদলাতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শীতকালেও ডেঙ্গু একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) গত পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই ৪ হাজার ৬৮৫টি ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে।

তুলনামূলকভাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৭৪৫ জন, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৯ হাজার ২৮৮ জন এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৫ হাজার ২৪ জন। আগের বছরগুলোতে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে ছিল—২০২১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০৭ এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ২৩১টি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে চারটি বিষয়ের ওপর একযোগে জোর না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। এসব বিষয় হলো—বিজ্ঞানসম্মত মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং সমন্বিত প্রশাসনিক উদ্যোগ।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে গেলে এডিস মশার বংশবিস্তারও কমে। ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণও কম হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২৫ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিক তাপমাত্রার ধারা ব্যাহত হচ্ছে। শীতকালও এখন তুলনামূলকভাবে উষ্ণ থাকছে, যা এডিস মশার জীবনচক্র সচল রাখতে সহায়ক হচ্ছে।

অধ্যাপক বাশার বলেন, 'এডিস মশা সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভালোভাবে বংশবিস্তার করে। বাংলাদেশে শীতকালেও অনেক সময় তাপমাত্রা এই সীমার মধ্যেই থাকে।'

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এডিস মশার আচরণেও পড়েছে। দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এখন এই মশা শুধু বাইরে ছোট পানিভরা পাত্রেই নয়, বরং নালা, বন্ধ হয়ে থাকা পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং ভবনের বেজমেন্টেও বংশবিস্তার করছে।

অধ্যাপক বাশার জানান, এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো 'ব্রুটো ইনডেক্স'। অনেক এলাকায় এই সূচক এখনো ২০-এর ওপরে রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ব্রেটো ইনডেক্স ২০ ছাড়িয়ে গেলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি হঠাৎ বেড়ে যায়। এর ফলেই শীতকালেও সংক্রমণ অব্যাহত থাকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শীতকালে বৃষ্টির পানি কমে গেলেও অনেক জায়গায় সারা বছরই পানি জমে থাকে।

এসব জায়গার মধ্যে আছে—নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, বাথরুমের কাছে রাখা বালতি বা ড্রাম, ওয়াসার মিটার চেম্বার, বহুতল ভবনের পার্কিংয়ে গাড়ি ধোয়ার স্থান এবং বন্ধ হয়ে থাকা নালা ও স্যুয়ারেজ লাইন।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'বৃষ্টি না থাকলেও শীতকালে এসব স্থানই এডিস মশার প্রধান বংশবিস্তারের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এসব জায়গায় ডিম পাড়ার ফলে নির্দিষ্ট এলাকা বা বাড়িতে বেশি সংক্রমণ দেখা যায়, যাকে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে "হটস্পট" বলি।'

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বংশবিস্তারের উৎসগুলোর মধ্যে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ পাওয়া গেছে বেজমেন্ট বা পার্কিং এলাকায়, ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্লাস্টিক বালতি ও পানি মিটারের গর্তে এবং ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ গেটের পানি নিষ্কাশন চ্যানেলে।

এ ছাড়া প্লাস্টিক ড্রাম, ফুলের টব, পানির ট্যাংক ও ধাতব পাত্রও এডিসের সাধারণ বংশবিস্তারের উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

জরিপে এসব উৎসে পূর্ণবয়স্ক মশা উৎপাদনের সক্ষমতাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মশা পাওয়া গেছে পানি জমে থাকা ফ্লোরে—৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে বেজমেন্ট বা পার্কিং এলাকা—১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং বন্ধ প্লাস্টিক ড্রাম—১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

অধ্যাপক বাশার সতর্ক করে বলেন, 'এই হটস্পটগুলো নিয়ন্ত্রণে না আনলে শীতকালজুড়েই ডেঙ্গু সংক্রমণ চলতে থাকবে।'

শীতকালে ডেঙ্গু মোকাবিলায় তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে হটস্পটভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দেন। আক্রান্ত রোগীদের ঠিকানা শনাক্ত করে দ্রুত ওই এলাকায় ফগিং করতে হবে, যেন সংক্রমিত মশা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে। তবে হটস্পটের বাইরে নির্বিচারে ফগিং করা অপ্রয়োজনীয় এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও অযৌক্তিক বলে তিনি মনে করেন।

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোতেও নিয়মিত ফগিং করার পাশাপাশি রোগীদের অবশ্যই মশারি টানিয়ে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

অধ্যাপক বাশার আরও বলেন, ১৫ দিনের একটি নিবিড় পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে এডিসের বংশবিস্তারের স্থানগুলো ধ্বংস করা গেলে ডিসেম্বরের মধ্যেই সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিটি করপোরেশন একা এ কাজে সফল হতে পারবে না। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

তিনি পরামর্শ দেন, বাড়িতে যেসব পাত্রে পানি রাখা হয়, সেগুলো তিন দিন পরপর সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বাথরুমের বালতি, ফুলের টব ও এসির ট্রে—সবই এডিস মশার সম্ভাব্য বংশবিস্তারের স্থান।

ঢাকায় বহু বছর ধরে ডেঙ্গু প্রায় মহামারির রূপ নিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক বাশার বলেন, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে একই পরিস্থিতি এড়াতে স্থানীয় প্রশাসনকে এখন থেকেই সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

অন্যদিকে কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমলেও এটি শিগগিরই পুরোপুরি নির্মূল হবে না।

তিনি বলেন, 'যেসব পাত্রে আগে পানি ছিল, সেগুলো শুকিয়ে গেলেও সেখানে এডিস মশার ডিম থাকতে পারে। তাই এসব পাত্র ফেলে দিতে হবে এবং সক্রিয় বংশবিস্তারের জায়গাগুলো দ্রুত ধ্বংস করতে হবে।'

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, 'কর্তৃপক্ষের হাতে এখন খুবই অল্প সময় আছে। এখনই যদি কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে মার্চ বা এপ্রিলে প্রথম বৃষ্টির পর যে ডেঙ্গুর বড় ঢেউ আসে, তা কিছুটা হলেও বিলম্বিত করা সম্ভব।'