দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে অস্বাভাবিক বন্যায় শতশত মৃত্যু, কারণ কী

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
30 November 2025, 16:41 PM
UPDATED 30 November 2025, 22:55 PM

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নজিরবিহীন বন্যা ও ভূমিধসে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লক্ষাধিক বাড়িঘর ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরল আবহাওয়া ব্যবস্থা, মানবসৃষ্ট জটিলতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে।

মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি

চলতি নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় বন্যা ও ভূমিধস ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

বিবিসি জানিয়েছে, ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রায় ২ লাখ বাড়িঘর ও বিস্তীর্ণ কৃষিজমি পানিতে ডুবে গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে বিরল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় 'সেনিয়া'র প্রভাবে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪২ জনে, এবং শত শত মানুষ এখনো নিখোঁজ। বহু এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২১ লাখ মানুষ।

বিবিসির তথ্যমতে, শ্রীলঙ্কায় রেকর্ড বন্যায় অন্তত ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। উদ্ধারকাজ চলমান থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে; ধ্বংস হয়েছে সড়ক, সেতু, কৃষিজমি এবং জরুরি অবকাঠামো।

2025-11-01t063114z_1785688527_rc2enhanlb5o_rtrmadp_3_asia-weather-vietnam.jpg
ভিয়েতনামের হোই আন শহরে বন্যায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে হাঁটছেন পথচারীরা। ছবি: রয়টার্স

বিরল আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণ

আল জাজিরা জানিয়েছে, ভিয়েতনামের হাত ইয়াই শহরে একদিনে ৩৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে যা গত ৩০০ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। একই সময়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের একাধিক অঞ্চলে টানা বৃষ্টিপাত রেকর্ড ভেঙেছে।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল নিউজ এশিয়া (সিএনএ) জানায়, একই সঙ্গে সক্রিয় ছিল লা নিনা এবং নেগেটিভ ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপোল (আইওডি) নামে দুটি বিরল ও শক্তিশালী জলবায়ু ব্যবস্থা।

নেগেটিভ আইওডিতে পূর্ব ভারত মহাসাগর উষ্ণ হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার দিকে বৃষ্টিপাত বাড়ায়, আর লা নিনা বৃষ্টিকে আরও তীব্র করে তোলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই ব্যবস্থার মিলিত প্রভাবে আর্দ্রতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে অতি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভিয়েতনামের একাধিক নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর হিউ শহরে ২৪ ঘণ্টায় ১ থেকে ১.৭ মিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হওয়াকে 'অস্বাভাবিক' হিসেবে উল্লেখ করেছেন গবেষকেরা।

মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ও অব্যবস্থাপনা

ইউরোপভিত্তিক গণমাধ্যম মডার্ন ডিপ্লোম্যাসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট ঘটনাও এ বিপর্যয়কে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। গত দুই দশকে ইন্দোনেশিয়ায় বিপুল বন উজাড় করা হয়েছে। পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ও নদী ভরাটের ফলে পানি শোষণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।

থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বহু জায়গায় দুর্বল নিষ্কাশনব্যবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং দুর্যোগ–প্রস্তুতির ঘাটতি অল্প বৃষ্টিতেই আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

উদ্ধার তৎপরতা ও চলমান সংকট

বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বহু এলাকায় উদ্ধারকাজ বিলম্বিত হয়েছে। ভিয়েতনামে ১১ লাখ পরিবার বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য ও আশ্রয়ের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, আর সরকারি সহায়তা দ্রুত না পৌঁছানোয় সংকট আরও জটিল হয়েছে।

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

সিএনএ সতর্ক করেছে, লা নিনা অন্তত ২০২৬ সালের শুরু পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। ফলে পরবর্তী কয়েক মাসেও অস্বাভাবিক ভারী বৃষ্টিপাতের ঝুঁকি আছে। এদিকে পানির কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়া মাটি ও দুর্বল অবকাঠামো ভবিষ্যতের বন্যা ও ভূমিধসকে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।

জলবায়ু অভিযোজন, বন সংরক্ষণ, শহর–পরিকল্পনা ও নদী–ব্যবস্থাপনা দ্রুত জোরদার না করলে এমন বিপর্যয় নতুন বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে।

মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি সতর্কবার্তায় বলেছে, 'বৃষ্টি স্বাভাবিক; বিপর্যয় স্বাভাবিক নয়।'