ঢাকাই সিনেমার সোনালি যুগের ১০ কিংবদন্তি পরিচালক

শাহ আলম সাজু
শাহ আলম সাজু
15 November 2025, 18:39 PM
UPDATED 25 November 2025, 20:26 PM

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে উর্দু ও হিন্দি সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও উজ্জ্বল ছিল ঢাকাই চলচ্চিত্র। ৬০ থেকে ৯০ দশকের সোনালি সময়ে দর্শকনন্দিত ও কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ঢাকাই সিনেমাকে স্থিতি, জনপ্রিয়তা ও শিল্পমানের শিখরে পৌঁছে দেন কয়েকজন কিংবদন্তি পরিচালক। তাদের অবদান আজও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমলিন। চলুন জেনে নেওয়া যাক, সেই ১০ গুণী পরিচালকের সম্পর্কে, যাদের হাতে গড়ে উঠেছিল ঢাকাই সিনেমার সোনালি যুগ।

কাজী জহির

প্রেম ও সামাজিক ঘরানার নির্মাণে এক অনন্য নাম কাজী জহির। তার সিনেমা দর্শকদের আবেগকে নাড়া দিতো। কাজী জহিরের 'অবুঝ মন'-এর জনপ্রিয়তা প্রজন্ম পেরিয়েও অটুট আছে। রুপালি পর্দায় ত্রিভুজ প্রেমের নাটকীয় উপস্থাপনায় ছবিটি দারুণ সাড়া ফেলে। সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল 'ময়নামতি' ও 'বধূ বিদায়', যা দিনের পর দিন প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৬৪ সালে তার প্রথম চলচ্চিত্র 'বন্ধন' মুক্তি পায়। পরবর্তী সময়ে 'ভাইয়া', 'নয়নতারা', 'মধু মিলন', 'ফুলের মালা'সহ বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরিচালক ছাড়াও তিনি ছিলেন সফল প্রযোজক ও পরিবেশক। এই গুণী নির্মাতার কর্মযজ্ঞ ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে বিশেষভাবে সমাদৃত।

খান আতাউর রহমান

'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' পরিচালনা করে খান আতাউর রহমান হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। সাদা-কালো যুগের এই চলচ্চিত্রটি তাকে জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত ও স্মরণীয় নির্মাতায় পরিণত করে। 

পরিচালনা, অভিনয়, সুর, সংগীত, গীত রচনা, চিত্রনাট্যসহ বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে 'অনেক দিনের চেনা' তার পরিচালনায় আসে।

'সুজন সখী', 'জোয়ার ভাটা', 'সাত ভাই চম্পা', 'অরুণ বরুণ কিরণমালা', 'আবার তোরা মানুষ হ', 'পরশ পাথর', 'হিসাব নিকাশ,' তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। 'জীবন থেকে নেয়া'সহ বেশকিছু ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন, যেখানে আনোয়ার হোসেনের 'মুকুটহীন নবাব' পরিচিতি পাওয়ায় তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এহতেশাম

তারকা তৈরির কারিগর এহতেশাম নতুন মুখ আবিষ্কারে অনন্য ছিলেন। শাবানা, শবনম, শাবনাজ, শাবনূরের মতো তারকারা তার হাত ধরেই ঢালিউডে আসেন।

১৯৫৯ সালে 'এ দেশ তোমার আমার' পরিচালনার মাধ্যমে শুরু করে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। 'রাজধানীর বুকে' মুক্তির পর তার নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে; ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ঢল নামায়। 'চান্দা', 'চকোরী', 'পিচঢালা পথ', 'নতুন সুর', 'দূরদেশ', 'পরদেশী'—সবই ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া ছবি। নাঈম–শাবনাজের জনপ্রিয় ছবি 'চাঁদনী'ও তার সৃষ্টি।

উর্দু ভাষায় 'চান্দা' ও 'চকোরী' নির্মাণ করে তিনি উভয় ভাষার চলচ্চিত্রেই শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।

সুভাষ দত্ত

সুভাষ দত্ত একইসঙ্গে নির্মাতা, অভিনেতা এবং তারকা তৈরির আরেক কারিগর। ১৯৬৪ সালে 'সুতরাং' নির্মাণের মাধ্যমে কবরীর রুপালি পর্দায় আগমন ঘটে। পরবর্তীতে উজ্জ্বলকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'বিনিময়' ছবির মাধ্যমে, যেখানে কবরী ছিলেন নায়িকা।

সুভাষ দত্ত.jpg
নির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রথম ছবি 'বসুন্ধরা'ও তার পরিচালনা। প্রয়াত শর্মিলী আহমেদের প্রথম ছবি 'আবির্ভাব' নির্মাণ করেন তিনি। জনপ্রিয় নায়িকা সুচন্দার আগমনও ঘটে তার পরিচালিত 'কাগজের নৌকা'য়। নির্মাতা হওয়ার আগে তিনি অনেক ছবিতে অভিনয় করে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

জহির রায়হান

বাংলা চলচ্চিত্রে আধুনিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বক্তব্য উপস্থাপনায় জহির রায়হান ছিলেন পথিকৃৎ। 'জীবন থেকে নেয়া' আজও রাজনৈতিক উপমায় নির্মিত সেরা বাংলা চলচ্চিত্রগুলোর একটি।

জহির রায়হান.jpg
জহির রায়হান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৬১ সালে 'কখনো আসেনি' দিয়ে শুরু করে তিনি 'সংগম', 'বেহুলা', 'আনোয়ারা', 'কাঁচের দেয়াল'সহ বহু উল্লেখযোগ্য ছবি নির্মাণ করেন। 'কাচের দেয়াল'-এর জন্য তিনি নিগার পুরস্কার পান।

ডকুমেন্টারি 'স্টপ জেনোসাইড' আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশিদের ওপর গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়, যা তাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রপাড়ায়ও পরিচিত করে।

আমজাদ হোসেন

সাহিত্য, অভিনয় ও পরিচালনা—তিন ধারায় সমান পারদর্শী আমজাদ হোসেন 'নয়নমনি' দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ছবিটি দর্শকের হৃদয় জয় করে।

aamjaad_hosen.jpg
আমজাদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

'গোলাপী এখন ট্রেনে' তার অন্যতম সেরা নির্মাণ, যা আজও জনপ্রিয়। এছাড়া 'ভাত দে', 'জন্ম থেকে জ্বলছি', 'কসাই', 'দুই পয়সার আলতা' সবই প্রশংসিত। 'আগুন নিয়ে খেলা' ছিল তার প্রথম পরিচালনা।

ক্ল্যাসিক ঘরানার নির্মাণে তিনি ছিলেন বিশেষ দক্ষ; তার চলচ্চিত্রে মানবিকতা, সমাজবাস্তবতা ও নান্দনিক গল্প বলার অনন্য সমন্বয় দেখা যায়।

সালাহউদ্দিন

বাংলা সিনেমাকে উর্দুর জনপ্রিয় বাজার থেকে আলাদা করে নিজস্ব দর্শকগোষ্ঠী তৈরি করতে যে পরিচালকদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে অন্যতম সালাহউদ্দিন।

'রূপবান' ছবিটি দর্শকের মধ্যে এমন ঝড় তোলে যে উর্দু সিনেমার বাজার প্রায় ভেঙে পড়ে। 

১৯৬১ সালে 'যে নদী মরু পথে' দিয়ে পরিচালনায় শুরু করে তিনি। এরপর 'সূর্যস্নান', 'ধারাপাত' ও 'আলো মাটি' নির্মাণ করেন যেগুলো সেই সময়ের দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

আজিজুর রহমান

পারিবারিক, সামাজিক ও লোককাহিনি নির্ভর সিনেমায় জনপ্রিয় পরিচালকদের মধ্যে আজিজুর রহমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার 'ছুটির ঘণ্টা' এবং 'অশিক্ষিত' সেই সময়ের অন্যতম আলোচিত ও প্রশংসিত ছবি। এছাড়া 'মাটির ঘর', 'অনুরাগ', 'সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল'—এই ছবিগুলোও দর্শকের বিপুল ভালোবাসা পায়। তার নির্মাণে ছিল বহুমাত্রিকতার ছাপ। 'সমাধান', 'স্বীকৃতি', 'অপরাধ', 'মায়ের আঁচল', 'কুচবরণ কন্যা'সহ বিপুলসংখ্যক ছবি উপহার দেন তিনি।

aajijur_rhmaan.jpg
আজিজুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

ইবনে মিজান

ফোক–ফ্যান্টাসি ধারার সবচেয়ে সফল ও ব্যবসাসফল নির্মাতা ছিলেন ইবনে মিজান। তার সিনেমা মানেই দর্শকের বিনোদন নিশ্চিত।

ibne_mijaan.jpg
ইবনে মিজান। ছবি: সংগৃহীত

'লাইলি মজনু' ও 'চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা' এখনো আলোচিত। ১৯৬৫ সালে তিনি 'একালের রূপকথা' দিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে 'নিশান', 'বাহাদুর', 'রাখাল বন্ধু', 'আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী', 'রাজকুমারী', 'রাজনর্তকী', 'সাগর কন্যা', 'বাহাদুর নওজোয়ান', 'জরিনা সুন্দরী'সহ অসংখ্য সিনেমা নির্মাণ করেন। উর্দু ভাষাতেও সফলভাবে কাজ করেছেন।

আলমগীর কবির

শৈল্পিক নন্দন ও মননশীলতায় নির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য আলমগীর কবিরের নাম স্মরণীয়। তার 'ধীরে বহে মেঘনা' আজও ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত। আরও নির্মাণ করেন 'সীমানা পেরিয়ে', 'সূর্যকন্যা', 'রূপালী সৈকতে', 'মোহনা' ও 'পরিণীতা'।

aalmgiir_kbir.jpg
আলমগীর কবির। ছবি: সংগৃহীত

নায়ক বুলবুল আহমেদকে নিয়ে নির্মিত 'মহানায়ক' ছিল তার আরেক আলোচিত কাজ। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন, যা তার শৈল্পিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক।