রপ্তানি বাজারে এখনো বৈচিত্র্য আসেনি, আটকে আছে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে

সোহেল পারভেজ
সোহেল পারভেজ
24 August 2025, 03:55 AM
UPDATED 24 August 2025, 10:59 AM

বছরের পর বছর ধরে নীতি নির্ধারক ও ব্যবসায়ীরা দেশের রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্য ও গন্তব্য বহুমুখী করার কথা বলে আসছেন। কিন্তু বাস্তবে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। এমনকি সরকারের উদার প্রণোদনা নীতি থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি এখনো কয়েকটি নির্দিষ্ট পণ্য ও বাজারের ওপরই বেশি নির্ভরশীল।

বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশেরও বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। আর। মোট রপ্তানি আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে।

সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানির মধ্যে এই দুই অঞ্চলে রপ্তানি পরিমাণ সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে, যা তিন বছর আগে ছিল ৬৫ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানিকাররা শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নে মোট রপ্তানির ৪৪ শতাংশ পাঠিয়েছেন। এর বড় কারণ হলো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'কোম্পানিগুলো কেবল ওই দেশগুলোতেই পণ্য পাঠাতে চায়, এটা মূল কারণ নয়। আসল সমস্যা হলো আমাদের রপ্তানি ঝুঁড়ি এখনো পোশাককেন্দ্রিক। পোশাক ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক ও বড় আকারে উৎপাদনযোগ্য নতুন পণ্যের সংখ্যা খুবই কম। তাই নতুন বাজারে প্রবেশ করা কার্যত কঠিন।'

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'পণ্যের বৈচিত্র্য সীমিত থাকলে বাজারের বৈচিত্র্যও টেকসইভাবে বাড়তে পারে না। তাই 'অপ্রচলিত' বাজারের জন্য নগদ প্রণোদনা দিলেও সামগ্রিকভাবে রপ্তানি বাজারের অবস্থান তেমন পরিবর্তন হয় না।'

সরকার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে প্রণোদনাকে 'একটি কৌশলগত হাতিয়ার' মনে করে বলে মন্তব্য করেনি তিনি।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে সাত হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ছয় শতাংশ বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে রপ্তানিকারকরা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা পেয়েছেন।

বর্তমানে ৪৩টি পণ্যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো বাজারের বাইরে রপ্তানি উৎসাহিত করতে সরকার পোশাক রপ্তানিকারকদের ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়।

তবে এই সহায়তা আসলেই কতটা কার্যকর—তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'প্রণোদনা আসলেই কোনো সুফল বয়ে আনছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।'

তিনি বলেন, রপ্তানি পোশাকের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল যে, মোট প্রণোদনার দুই-তৃতীয়াংশ ওই খাতে চলে যাচ্ছে।

'কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো হওয়া উচিত। রপ্তানি প্রণোদনা হওয়া উচিত লক্ষ্যভিত্তিক, বাজারভিত্তিক ও প্রভাবভিত্তিক। অথচ আমরা দেখি, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, সমিতি, লবিস্ট এমনকি নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের দাবির প্রেক্ষিতে অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়।'

অন্যদিকে মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বৈশ্বিক চাহিদায় এই ভারসাম্যহীনতার কারণ।

তিনি বলেন, 'ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক ভোক্তা বাজার। এখানে আছে ঘনবসতিপূর্ণ ক্রেতা নেটওয়ার্ক, প্রতিষ্ঠিত কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থা। তাই তাদের বিপুল ও নিয়মিত অর্ডার দেওয়ার সক্ষমতা আছে।'

'বাংলাদেশি কোম্পানির জন্য, বিশেষ করে যারা দ্রুত পোশাক তৈরি করে, তাদের জন্য এই বাজারগুলো থেকে বড় অর্ডার নেওয়া, বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখা ও মান বজায় রাখা সহজ করে দেয়। তাই স্বাভাবিকভাবে কেবল নীতি-প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি বাজার বদলানো যায়নি।'

মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পোশাকের বাইরে অনেক খাত বিদেশে গুণমান পূরণে সমস্যার মুখোমুখি হয়। এছাড়া দেশের সার্টিফিকেশন, পরীক্ষণ ও বিদেশে স্বীকৃতি সংক্রান্ত দুর্বলতা সমস্যা আরও প্রকট করে, কারণ এগুলো ব্যয় বাড়ায় এবং বাজারে প্রবেশের গতি কমিয়ে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানি সক্ষমতার ঘাটতি ও মান সংক্রান্ত বাধার কারণে চাপে আছে। যতক্ষণ না এগুলো সমাধান হয়, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো কঠিন হবে।

তিনি যোগ করেন, 'উচ্চ লজিস্টিক খরচ, জ্যাম, দুর্বল অভ্যন্তরীণ পরিবহন ও দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

'দেশে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অভাব এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে রক্ষা করতে উচ্চ শুল্কের ওপর নির্ভরতা রপ্তানি বৃদ্ধিকে নিরুৎসাহিত করে,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতে রপ্তানি বাড়ছে।

তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র প্রণোদনা কাজ করবে না। নতুন বাজার গড়তে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমরা জাপানের বাজার ধরতে অনেক চেষ্টা করেছি। আমাদের নির্দিষ্ট বাজারকে লক্ষ্যবস্তু করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশকে পোশাকের বাইরে আরও পণ্য খাত বাড়াতে হবে।

'বাংলাদেশকে পোশাকের বাইরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য, যেমন হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ইলেকট্রনিকস ও আইটি সেবায় বিনিয়োগ করতে হবে। বাণিজ্য কূটনীতি শক্তিশালী করতে হবে, যেন এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার উদীয়মান বাজারের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা বা শুল্ক বাধা কমানো যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'বাজার গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে মিলিয়ে সরকারি সহায়তা আরও লক্ষ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। যেন রপ্তানিকারকরা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে।'

সিপিডির খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রণোদনা সরাসরি বাজারের জন্য দেওয়ার বদলে পুরো সরবরাহ চেইনের জন্য দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, 'আমাদের একটি খাতভিত্তিক সাপ্লাই-চেইন নীতি তৈরি করা দরকার, যেন কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন ও বাজার সবই অন্তর্ভুক্ত থাকে।'

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কার্যনির্বাহী উপ-সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশই বৈচিত্র্য আনার মূল চাবিকাঠি।

তিনি বলেন, 'আমাদের নীতি সহায়তা এমনভাবে তৈরি করা উচিত, তা হবে অন্যান্য দেশের দেওয়া সহায়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের শুল্ক ও কাস্টমস প্রক্রিয়াগুলো সহজ করা উচিত এবং বাজারে পৌঁছানোর সময় কমাতে হবে।'

'যদি আমদানি শুল্ক কমানো হয় ও রপ্তানিকারকদের সমান সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে অনেক পণ্য প্রতিযোগিতামূলক হবে,' যোগ করেন তিনি।