এবি ব্যাংকের ‘গোপন’ মন্দ ঋণ, খেলাপি বেড়ে ৮৪ শতাংশ

মো. মেহেদী হাসান
মো. মেহেদী হাসান
23 November 2025, 04:53 AM
UPDATED 23 November 2025, 11:33 AM

এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নজিরবিহীনভাবে বেড়ে প্রায় ৮৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংকটির দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্বলতার কারণে আর্থিক সংকট সামনে এসেছে।

ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের সর্বশেষ বিবরণী অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩৫ হাজার ৯৮২ কোটি। এর মধ্যে ৩০ হাজার ১৩৮ কোটি সময়মতো আদায় করা যায়নি এবং তা আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ১১৫ কোটি, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর খেলাপি ঋণ এত বেশি হওয়ার কারণ আগের ২০ হাজার ২৩ কোটি 'গোপন করা' বা প্রকাশ না করা খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেখানো হয়েছে।

এমন সময়ে এ তথ্য সামনে এলো যখন সরকারের ব্যাংকিং রিফর্ম টাস্কফোর্সের সুপারিশে একটি বিদেশি অডিট ফার্ম এবি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অডিটর ইতোমধ্যে ব্যাংকটির সম্পদের গুণগত মান পর্যালোচনা করেছে। যেখানে ঋণ সঠিকভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে কি না তা যাচাই করা হয়।

অডিটর খুব শিগগিরই পুরো প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

মন্দ ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা

এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবি ব্যাংক বহুদিন ধরে তাদের চাপে থাকা সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ গোপন করে আসছিল। তাদের মতে, এর পেছনে রয়েছে অনিয়মিত ব্যবস্থাপনা, ঋণ সুবিধার অপব্যবহার এবং বড় ঋণ আদায়ে দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা।

তারা আরও বলেন, বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশন বিলম্বিত সুবিধা ব্যবহার করে তাদের আর্থিক অবস্থা বাস্তবের চেয়ে ভালো দেখাত। এভাবে তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মন্দ ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা বিষয়টি আড়াল করে রেখেছিল।

তবে সর্বশেষ তথ্য প্রকাশের পর দেখা গেছে, ব্যাংকটির প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচকই এখন অবনতির দিকে।

অডিটের জেরে আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা চেয়েছে এবি ব্যাংক, যেন তারা প্রতিদিনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। ব্যাংকটি এমন সময়ে এই সহায়তা চেয়েছে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি দুর্বলকে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়ায় আছে।

তারল্য সহায়তা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া জরুরি নগদ অর্থ, যা সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের অর্থ উত্তোলনের চাহিদা পূরণে সাহায্য করে।

এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ইতোমধ্যে ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা নিয়েছে এবি ব্যাংক। তাদের মতো আরও আটটি ব্যাংক একই সহায়তা পেয়েছে।

এবি ব্যাংকের এই সংকটের প্রভাবে শীর্ষ ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন এসেছে। গত ১৯ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মিজানুর রহমান ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেলে তিনি মেঘনা ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর এ বছরের মে মাসে তিনি এবি ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব নেন। গত সপ্তাহে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ব্যাংকটি ঋণের বিপরীতে খেলাপি গ্রাহকের বন্ধকি সম্পদের মালিকানা নিয়ে নেয়, তবে তা ব্যাংক বহির্ভূত সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়। এতে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখায়। কারণ ব্যাংক বহির্ভূত সম্পদকে খেলাপি ঋণ হিসেবে ধরা হয় না।

'কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে ওই সম্পদের মালিকানা নিতে ব্যর্থ হয়, ফলে এগুলো পুনরায় খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়,' বলেন তিনি।

এবি ব্যাংকের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ব্যাংক বহির্ভূত সম্পদ পুনরায় খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, প্রাক্তন চেয়ারম্যানের সঙ্গে যুক্ত একটি আইনি ফার্মের সহায়তায় বন্ধক রাখা সম্পদকে ব্যাংক বহির্ভূত সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয়।

এবি ব্যাংক এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩ হাজার ১১৩ কোটি নেট ক্ষতি দেখিয়েছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ২৯৮ কোটি এবং নেট ক্ষতি ছিল ১ হাজার ৯১৭ কোটি। যখন কোনো ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অর্থ রাখতে ব্যর্থ হয় তখন মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়।

১৯৮১ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবি ব্যাংক। তবে ব্যাংকটির সমস্যাগুলো হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। এই সমস্যার শুরু হয় অন্তত আট বছর আগে, ২০১৬ সালে ব্যাংকটির মানি লন্ডারিং কেলেঙ্কারির তথ্য সামনে আসে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, দুটি সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌঁছায়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই সময়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এম. মোর্শেদ খানের পরিবারের হাতে। তিনি বিএনপি সরকারের সময়ের একজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ছিলেন এবং এবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের একজন।

ওই কেলেঙ্কারির সময় এম. ওহিদুল হক ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে ২০১৭ সালে তিনিসহ ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদ ও পরিচালক ফাহিমুল হক পদত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে বছরই বেসরকারি ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে এবং এখনও এবি ব্যাংকের কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সমন্বয়ক তদারকি করেন। কারণ ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা এখনও স্থিতিশীল হয়নি।

পরে অর্থপাচারের অভিযোগে ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান এম. ওহিদুল হকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ২০১৯ সালে তারিক আফজালকে প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দায়িত্বকাল রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান ছিলেন।

সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, এবি ব্যাংক এখনো বেশ কয়েকটি করপোরেট গ্রুপের কাছ থেকে বড় ঋণ আদায়ে সংগ্রাম করছে। এই তালিকায় আছে—বেক্সিমকো, সিকদার, এশিয়ান সিটি, বিল্ডট্রেড, ওরিয়ন ও মাহিন। এসব ঋণের বেশিরভাগই এখন খেলাপি এবং আইনি কার্যক্রম চলমান আছে।