টাকার মান কমায় বাড়ছে মেগা প্রকল্পের ব্যয়
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ঢাকার মেট্রোরেলসহ বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নাধীন বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের হিসাবে প্রকল্পের মূল ব্যয় অপরিবর্তিত থাকলেও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে টাকার অংকে খরচ বাড়ছে।
চলমান মাগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে শুধু রূপপুর প্রকল্পেরই প্রাক্কলিত ব্যয় ২৬ হাজার ১৮১ কোটি টাকা বা ২৩ শতাংশ বাড়তে পারে। তবে ডলারের হিসাবে প্রকল্পের খরচে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, টাকার মান পড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যখন ধীরগতি এবং রাজস্ব আয়ে স্থবিরতা দেখা দেয়, তখন এই চাপ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।
২০১৬ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সে সময় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮০ টাকা ধরে রাশিয়ার ঋণসহায়তার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। অনুমোদনের পর কয়েক বছর ডলারের দর ৮৫ টাকার কাছাকাছি ছিল।
করোনা মহামারির পর আমদানির চাপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যায়। এতে দেশের ডলারের মজুত দ্রুত কমতে থাকে। ডলার–সংকটের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বাজারভিত্তিক দরে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৫ টাকার ঘরে পৌঁছায়।
কিন্তু টাকার এই অবমূল্যায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন করা হয়নি। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের মতে, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে ডলারের দাম বাড়ার বিষয়টি পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি। তাদের নিজস্ব হিসাব বলছে, ব্যয় বেড়ে ১ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে ৮ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যার গড় বিনিময় হার ছিল ৯৫ টাকা ২৮ পয়সা। বাকি ৩ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২২ টাকা ৪০ পয়সা ধরা হয়েছে।
কমিশন বর্তমানে এই হিসাব পর্যালোচনা করছে এবং শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে। তারা বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঠিক খরচ নির্ধারণ এবং প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে এই সমন্বয় জরুরি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সম্ভাব্য দাম ৭ টাকার মতো হতে পারে বলে আলোচনা চলছে, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারে খরচ না বাড়লেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বাড়তি ঋণ পরিশোধের চাপ বাজেটের ওপর পড়বে। রাজস্ব আদায় না বাড়লে ঘাটতি আরও বাড়বে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, 'ঘাটতি মেটাতে সরকারকে হয়তো আবারও ঋণ নিতে হবে।' চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ঋণ পরিশোধ বাবদ খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে। টাকার অঙ্কে এই বৃদ্ধি ১৩ শতাংশ, যার মূল কারণ টাকার অবমূল্যায়ন। তিনি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও সরকারি ব্যয় কমানোর ওপর জোর দেন।
মেট্রোরেল প্রকল্পেও ব্যয়ের ধাক্কা
ব্যয় বৃদ্ধির চাপ কেবল রূপপুর প্রকল্পেই নয়, ঢাকার একাধিক মেট্রোরেল প্রকল্পেও পড়েছে।
উত্তরা থেকে মতিঝিলের মধ্যে দেশের প্রথম মেট্রোরেল লাইন-৬ এর নির্মাণ ব্যয় কিছুটা কমে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা থেকে ৩২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সরকারি অংশের ভূমি অধিগ্রহণের খরচ কমার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তবে বিদেশি ঋণের অংশের ব্যয় বেড়েছে। পরামর্শক ফি এবং ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত ২৭০ কোটি টাকা খরচ বেড়েছে। সরকার চলতি সপ্তাহে এই প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় অনুমোদন করেছে।
অন্য দুটি মেট্রোরেল প্রকল্প—এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫-এর ব্যয়ও বাড়ার পথে। ২০১৯ সালে যখন জাইকার অর্থায়নে এই প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে টাকার মান ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে, যার ফলে বড় ধরনের ব্যয় সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি এমআরটি-১-এর এক কর্মকর্তা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিএমটিসিএল) জানিয়েছেন, জাপানি ঋণের অংশের ব্যয় ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা হতে পারে। অথচ যেখানে মূল প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
একইভাবে হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী, মিরপুর ও গুলশান হয়ে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৫-এর ব্যয়ও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১০টি প্যাকেজে ভাগ করা এই প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী, একটি প্যাকেজের ব্যয় ৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৫ হাজার ৫২৭ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সামগ্রিক খরচ কমাতে জাইকা ও সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে।