রাষ্ট্র সংস্কার শুরু হোক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে

By এম এম নুরুজ্জামান ও রায়হান আহমেদ
1 November 2025, 15:53 PM

বাংলাদেশে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে জনগণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নিজেদের রাজনৈতিক অভিজাতদের কাছে বন্দি মনে করে। আর স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ তাদের রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোগের একমাত্র সূত্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে রাজনৈতিক পরিচয় বা সুপারিশ ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের জন্য এ সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ও হয়রানিমূলক।

তবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পতনের পর সাধারণ মানুষ মনে করছে, তারা আবারও বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন-পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণের মধ্যে প্রশাসনিক, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

জনগণের এই প্রত্যাশা ও আগ্রহের বিষয়টি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত 'স্থানীয় সরকার পরিষেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা' শীর্ষক গবেষণায় আরও বিশদভাবে উঠে এসেছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে ও নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের আশা-প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারছে সেটি দেখা।

উল্লেখিত গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় নীতি বা আইনের জটিল ভাষার পরিবর্তে দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পরিবর্তন উপলব্ধি করতে চায়। বিনা ভোগান্তিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে সব সেবা পাওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে জনগণের কাছে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিফলনের চিত্র। অথচ সংস্কার নিয়ে যে আলোচনা চলছে সেখানে এই অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিফলিত হয়নি। প্রশ্ন জাগে—তাহলে জনগণ কি রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কারের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না? যদি অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তাদের অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া কী এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের আলাপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা দৃশ্যমান?

গ্রামীণ মানুষ প্রতিনিয়ত ইউনিয়ন পরিষদে যায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদ, ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্রের জন্য। এই সেবাগুলো যখন অতিরিক্ত অর্থ, রাজনৈতিক প্রভাব ও দীর্ঘসূত্রিতা ছাড়াই পায়, তখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সুফল তাদের জীবনে এসেছে। অথচ সংস্কার আলোচনায় এসব ক্ষুদ্র কিন্তু মৌলিক প্রশাসনিক সেবা উপেক্ষিত।

এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ড, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল কিংবা আশ্রয়ণ প্রকল্প—সবই ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বিতরণ হয়। জনগণের প্রত্যাশা হলো এসব সুবিধা যেন প্রকৃত দাবিদারদের হাতে পৌঁছায়, সুপারিশ ও পক্ষপাতিত্বের জায়গা যেন না থাকে। বাস্তবে রাজনৈতিক প্রভাব, তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তাদের হতাশ করে।

অন্যদিকে, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে অনলাইনে ফরম পূরণ, পরীক্ষার ফলাফল দেখা বা চাকরির আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগের দুর্বলতা বা প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এই সেবাকে প্রায়ই ব্যাহত করে।

আবার, স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রম যেমন: রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থা, খাল খনন কিংবা স্থানীয় বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন—এসব কাজ ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে হয়। সাধারণ জনগণ এসব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে কাজগুলো স্বচ্ছ ও সফলভাবে সম্পন্ন করা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু আলোচনায় জনগণের এই অংশগ্রহণের উপায় অনুপস্থিত।

ইউনিয়ন পরিষদের আরেকটি বড় ভূমিকা হলো পারিবারিক, জমিজমা বা সামাজিক বিরোধের সালিশ। মানুষ চায় নিরপেক্ষ ও ন্যায্য মীমাংসা। কিন্তু অনেক সময় রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের স্বার্থ এতে প্রাধান্য পায়। 
স্থানীয় পর্যায়ের এই সেবপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির ধরনই জনগণ এবং সরকারের সম্পর্ক নিরূপণ করে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জনগণ প্রথমে আশাবাদী হয়েছিল। ভেবেছিল এই সেবাপ্রদান প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সেবা প্রদানের জায়গায় জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন আসবে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল ও দুর্বৃত্তের অরাজকতা, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় আচরণ এবং স্থানীয় সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় সাধারণ জনগণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আশাবাদ আবারও হারাতে বসেছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি কোনো পদক্ষেপ না থাকায় জনগণের সরকারের প্রতি তাদের হতাশা আরও ঘনীভূত হয়েছে এবং আস্থা কমে আসছে।

জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী সময় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গ্রামের শেষপ্রান্তের বাসিন্দারাও আন্দোলন, নির্বাচন, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিয়ে আলাপের জন্য প্রবলভাবে আগ্রহী ছিল। কিন্তু একবছর না যেতেই এই জায়গায় তফাৎটা চোখে পড়ার মতো। এখন জনগণ রাজনৈতিক আলাপে আগ্রহী নয়। বিগত সরকারের সময় কথা বলতে গিয়ে জনগণ যে ভীতির মধ্যে ছিল, সেই ভীতিটা এই মুহূর্তে ফিরে না এলেও সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা এটা অনুভব করছে যে, আগামীতে তাদের বাকস্বাধীনতার পথ সংকুচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। এই কারণেই এখন মানুষ রাজনৈতিক আলাপের চাইতে নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

সাতক্ষীরার গ্রামীণ বাজারের একটি চায়ের দোকান, যেখানে গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সন্ধ্যায় চায়ের কাপে ঝড় উঠতো রাজনৈতিক আলাপে, সেখানে এখন নিঃশব্দতা। দোকানের কোণায় বসা বয়স্ক এক ব্যক্তি বললেন, 'আগে ভয় ছিল সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, এখন সেটা নেই। নিজের পেট চালানোই বড় কথা, রাজনীতির গল্প করে কী হবে? এই দেশের কোনো পরিবর্তন হবে না। এই সরকারও কিছু করতে পারবে না।' 
এই হতাশা শুধু চায়ের দোকানে নয়, বিরাজ করছে গোটা সমাজে। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার ও রাজনীতিবিদদের খেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জনগণ আজ যেন আর কিছু বলতে চায় না। এই নীরবতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক হতাশা, আশাভঙ্গ এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের টানাপোড়ন।

বর্তমানে বাংলাদেশ এক পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব দেশের প্রতিটি স্তরেই দৃশ্যমান। রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের আলোচনা—এই রাজনৈতিক পাণ্ডুলিপি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও জনগণের কাছে এসব আলাপ বেশ জটিল। প্রশ্নটা এখানেই—জনগণের কাছে সংস্কারের আলাপ কেন জটিল এবং অবিশ্বাস্য?

জনগণের প্রত্যাশা

একজন প্রবীণ নাগরিক বলেছিলেন, 'এসব বড় বড় কথা, সংস্কার, পিআর, গণভোট—সব শুনি টিভিতে। কিন্তু আমাদের সমস্যা ছোট, আমাদের চাই ছোট ছোট সমাধান। পরিষদে (ইউনিয়ন) গিয়ে যেন আমাকে বারবার ঘুরতে না হয়।'

এই কথার মধ্যেই জনগণের প্রকৃত চাহিদা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্থানীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হয়রানি ছাড়াই সব সেবা পাওয়া, সামাজিক সুরক্ষা সুবিধায় স্বচ্ছতা, উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ, সালিশে ন্যায়বিচার এবং ডিজিটাল সেবায় নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকারই এখন জনগণের প্রত্যাশা।

সাধারণ জনগণ জানে না রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন কীভাবে আসবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কীভাবে ভূমিকা রাখবে। সংস্কার আলোচনায় জনগণের সেবা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো অনুপস্থিত, যার ফলে জনগণ ও রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। যদি সংস্কারের আলাপ জনগণের জীবনের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত না হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অবসাদ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের অনীহা এবং হতাশা তৈরি করতে পারে।

এম এম নুরুজ্জামান, মাঠ গবেষক এবং রায়হান আহমেদ, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (বিআইজিডি) কর্মরত