ভোটে আসে, চলেও যায়—জনবান্ধব রাজনীতি কোথায়?
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেকটা পুরোনো নাটকের নতুন মঞ্চায়নের মতো। দৃশ্যপট পাল্টায়, চরিত্র বদলায়, কিন্তু সংলাপ একই থাকে। ক্ষমতায় যে-ই আসুক, সবাই বলে জনগণের পাশে আছি; অথচ সময়ের পরতে পরতে দেখা যায়, সেই জনগণই মঞ্চের বাইরে পড়ে থাকে—তালি দেয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু গল্পের পরিণতি আর বদলায় না। পাঁচ দশক পার করেও আমাদের গণতন্ত্র তাই এক প্রশ্নের সামনে বারবার ফিরে আসে—জনগণ কবে ফিরে পাবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিজের স্থানটি? জনবান্ধব রাজনীতি কি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হবে?
জনবান্ধব রাজনীতি মানে শুধু ভোটমুখী প্রতিশ্রুতি নয়। এর মানে এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে নীতি ও সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে থাকে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন—চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, মর্যাদা। যেখানে রাজনীতি ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়, বরং মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি দায়িত্ব। এই রাজনীতি জনগণকে কেবল ভোটদাতা হিসেবে দেখে না, দেখে একজন নাগরিক হিসেবে, যার মতামত, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু আমাদের বাস্তবতা তো অন্য গল্প বলে। দলগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতর গুটিয়ে ফেলেছে বললেই চলে। আনুগত্যের রাজনীতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ভিড়ে দলীয় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রার্থী নির্বাচনে জনগণের আস্থা বা যোগ্যতার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পর্ক ও প্রভাব। এক কথায় বলা যায় এটা যেন সিলেকশন প্রক্রিয়া, কোন ইলেকশন নয়।
সংসদ, যেখানে জনগণের প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা ঠিক হওয়ার কথা, তা এখন অনেক সময়ই আনুষ্ঠানিক পরিসর মাত্র। বড় বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জনগণের সঙ্গে কথা না বলেই; স্থানীয় সরকারের ভূমিকা সীমিত, আর তরুণ নেতৃত্বের অংশগ্রহণও সামান্য। ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত, কিন্তু অনেক কম জনমুখী।
প্রতিবার নির্বাচনের মৌসুমে রাজনীতি যেন হঠাৎ করে আবার 'জনবান্ধব' হয়ে ওঠে। তখন জনগণকে নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি, মিছিল, স্লোগান যেন সব কিছুতেই প্রাণ ফিরে আসে। কিন্তু ভোট শেষ হলে সেই সংযোগ আবার হারিয়ে যায়। জনগণকে ভাবা হয়ে থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর দাস। বাস্তবতা তো হওয়ার কথা ছিল—রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ আপামর জনতার সুবিধা ও অসুবিধাগুলো সমাধানে সদা তৎপর অবস্থানে থাকবে।
বরং উল্টো চিত্রে দেখা মিলে ভোট শেষ হওয়া মাত্রই। রাজনীতি তখন তার পুরোনো রূপে ফিরে যায়—উপর থেকে নির্দেশ দেয়, নিচের মানুষ কেবল শুনে যায়। এই অস্থায়ী সংযোগ মানুষকে কেবল ব্যবহার করে, অন্তর্ভুক্ত করে না। অথচ সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব রাজনীতি মানে হলো নাগরিকের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ; এমন রাজনীতি, যা শোনে, বোঝে এবং সিদ্ধান্তে সেই শোনার প্রতিফলন ঘটায়।
এই বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে সমাজে। মানুষ রাজনীতিতে আস্থা হারাচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীরব আর তরুণরা যতবারই এই গৎবাঁধা রাজনীতির গল্প বদলে দিতে চেষ্টা করে, তখন তাদেরকে নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় ফেলে দেয় এক গোষ্ঠী।
বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর চোখে রাজনীতি ক্ষমতার লেনদেনের খেলা, যেখানে মূল্য পায় আনুগত্য। স্থান নেইর যোগ্যতার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য—মানুষের আস্থা ও অংশগ্রহণের ওপর দাঁড়িয়ে একটি ন্যায্য রাষ্ট্র গঠন। যখন জনগণ বিশ্বাস হারায় যে তাদের কথা শোনা হয় না, তখন ভালো নীতিও কার্যকর হয় না। কারণ সেই নীতির ভিতটাই দাঁড়িয়ে থাকে আস্থাহীনতার ওপর।
তবু সব হারিয়ে যায়নি। পরিবর্তনের সম্ভাবনা এখনো আছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিই চায়। দলীয় গণতন্ত্র পুনর্গঠন করা এখন সময়ের দাবি। তরুণ ও দক্ষ নেতৃত্বের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে, যেন রাজনীতিতে নতুন ভাবনা ও নতুন শক্তি আসে। নির্বাচনকে ব্যক্তির প্রতিযোগিতা নয়, নীতির প্রতিযোগিতায় পরিণত করতে হবে। নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও একাডেমিয়া—এই তিনটি ক্ষেত্রকে রাজনীতির সঙ্গে এক সেতুবন্ধনে আনতে হবে, যাতে তারা প্রশ্ন করতে পারে, পরামর্শ দিতে পারে, ভিন্নমত জানাতে পারে—ভয়মুক্তভাবে। প্রযুক্তিকেও ব্যবহার করা যেতে পারে নাগরিক মতামত শোনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে, প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গায় আরও সহনশীল অবস্থানে থাকতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা নীতির নয়, মানসিকতার। রাজনৈতিক নেতারা কি সত্যিই জনগণের কথা শুনতে প্রস্তুত? নাকি তারা কেবল ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখতেই আগ্রহী? তারা কি নাগরিকদের অংশীদার মনে করেন, নাকি শুধু ভোটব্যাংক হিসেবে দেখেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
রাজনীতি আসলে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার এক শিল্প। কিন্তু যখন সেই শিল্প আত্মরক্ষার অস্ত্রে পরিণত হয়, তখন গণতন্ত্র ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে যায়। জনবান্ধব রাজনীতি কোনো দূরের স্বপ্ন নয়, শুধু সৎ ইচ্ছা আর সাহসিকতার অপেক্ষা। যদি দলগুলো সেই আহ্বান শুনতে পারে, হয়তো আমরা আবার এমন এক রাজনীতি দেখতে পাব, যেখানে মানুষ কেবল দর্শক নয় হবে শক্তিশালী অংশীদার।
জুবাইয়া ঝুমা: পিআর প্রফেশনাল