চট্টগ্রামের বুকে অবিস্মরণীয় সেই গেরিলারা
দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে কাঁপছিল চট্টগ্রাম শহর ও পার্শ্ববর্তী জনপদ। কোথাও বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, তো কোথাও পেট্রলপাম্পে বিস্ফোরণ। এক ঘণ্টার ব্যবধানেই গোটা চট্টগ্রাম শহর বিস্ফোরণের নগরীতে পরিণত হয়। সেদিন ভোর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে শহরের অন্তত ৮৫টি স্থানে একযোগে গেরিলা হামলা চালিয়েছিলেন নগরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, গেরিলা হামলায় দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নগরের যুবক-তরুণদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিলে পাল্টা জবাব হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা এক দিনে ১০০টি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন।
এই গেরিলা দলগুলোর বিস্ফোরক প্রধান ও গ্রুপ কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'শেষ মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ এমরান ধরা পড়ায় তার ইউনিটের ১৫টি অপারেশন ছাড়া বাকি ৮৫টি অপারেশন সফল হয়েছিল।'
পাহাড়তলীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম বলেন, 'নিরাপত্তার খাতিরে সমন্বিত অপারেশনের বিষয়টি শুধু গ্রুপ কমান্ডাররাই জানতেন। ওই অপারেশনের পর পাকিস্তানিদের চলাচল স্বাভাবিক হতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল।'
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রাম শহরে অন্তত ৫০০ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন চার শতাধিক অপারেশনে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, একক কোনো নগর হিসেবে এটিই সর্বাধিক। চট্টগ্রাম শহরের গেরিলাযুদ্ধ নিয়ে এই প্রতিবেদনের কাজে গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে যান এই প্রতিবেদক। এ সময় অন্তত ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় তার।
চট্টগ্রামের গেরিলাযুদ্ধের বিবরণ রয়েছে একাধিক গ্রন্থে। জামাল উদ্দিনের 'মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর', মাহফুজুর রহমানের 'বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম', 'স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস' এর মধ্যে অন্যতম।
উল্লেখিত সব সূত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর নগর আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভী সৈয়দ আহম্মেদের নেতৃত্বে গোপনে ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের বাঙালি সেনারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও একপর্যায়ে তারাও পিছু হটেন। শহরের দখল নিয়ে বিহারি ও পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক গণহত্যা চালালে চট্টগ্রাম প্রায় জনহীন নগরীতে পরিণত হয়।
এপ্রিলের শুরুতে চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবকদের একাংশ প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যান। শহরে যারা ছিলেন, তারাও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। তখন মৌলভী সৈয়দ মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের লিফলেট ছাপালে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ বলেন, 'আগ্রহী ছাত্র-তরুণদের নিয়ে আগ্রাবাদের ছোটপুলে নূর মোহাম্মদের বাড়ির পাশের মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।'
এ সময় মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে আনসার ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা ছোটখাটো অপারেশনে অংশ নেন। ৭ মে নগরের হাজীপাড়ার আবদুল মোনাফ সওদাগরের বাড়িতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেন। নগরের পানওয়ালাপাড়ার সবুজবাগ হয়ে ওঠে গেরিলাদের প্রধান ঘাঁটি।
প্রথম পর্যায়ে গেরিলারা যেসব অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে অপারেশন চকবাজার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮ মে জাহাঙ্গীর গ্রুপের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কাপাসগোলা থেকে চকবাজার আসার পথে একটি জিপে চারজন পাকিস্তানি সেনাকে দেখতে পান। তারা গ্রেনেড ছুড়ে মারলে জিপটি ধ্বংস হয়ে চার সেনা নিহত হয়।
মে-জুন মাসে গেরিলাদের প্রধান দায়িত্বই ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি করা। মুক্তিযোদ্ধা দোস্ত মোহাম্মদ বলেন, 'একপর্যায়ে আমাদের ভারত থেকে আসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমরা নগরের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে আশ্রয়স্থান ঠিক করি।' জুন মাস থেকে গেরিলারা চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে শুরু করেন।
ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, 'এপ্রিল-মে মাসে ত্রিপুরার বগাফা, অম্পিনগরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৬ জুন আমরা ৯ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল প্রথম চট্টগ্রাম শহরে ঢুকি।'
প্রথমেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্দেশনা ছিল দালাল নির্মূলের। মুক্তিযোদ্ধা নুরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, 'শহরে কোনো দালাল, রাজাকারের চিহ্ন রাখা যাবে না—এমন নির্দেশনা ছিল। যেন বাকি গেরিলারা শহরে ঢুকতে পারে।' এই মুক্তিযোদ্ধারা একই সঙ্গে নিজ নিজ এলাকায় তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু করেন।
আগস্ট মাসে ডা. মাহবুব, ইঞ্জিনিয়ার হারুন ও ডা. মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে কর্ণফুলী কন্টিনজেন্ট নামক বিএলএফের তিনটি বৃহৎ গ্রুপের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নগরে প্রবেশ করেন। সেপ্টেম্বরে বিএলএফের আরও চারটি গ্রুপ ও অন্তত ৪০টি এফএফ গ্রুপ চট্টগ্রামে ঢুকলে নগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
চট্টগ্রামের গেরিলারা যেসব অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে অপারেশন আইস ফ্যাক্টরি, কৈবল্যধাম পেট্রল ট্রেন অপারেশন, অপারেশন হোটেল আগ্রাবাদ, অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, লাজাফ পেট্রলপাম্প অপারেশন, ময়কং চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বোমা হামলার অপারেশন ছিল উল্লেখযোগ্য।
১ নভেম্বর কর্মচারীদের বেতন বাবদ ২ লাখ টাকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি গাড়ি করে কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও গাড়িটির সন্ধান না পেয়ে নিউমার্কেটের কাছাকাছি আসতেই এক পাকিস্তানি সেনাকে দেখতে পেয়ে গুলি করলে সে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় কাছাকাছি দূরত্বে থাকা সেনারাও পাল্টা গুলি চালায়।
গুলিবিদ্ধ হন মুক্তিযোদ্ধা শফিউল বশর। পাল্টাপাল্টি গুলিবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে গেলেও পাকিস্তানি জিপ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় সিটি কলেজের সামনে নৌবাহিনীর গাড়ি থেকেও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। নিহত হয় ৯-১০ জন পাকিস্তানি সেনা। শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা রফিক।
অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক ভুঁইয়া বলেন, 'রফিক শহীদ হলেও আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাই। যুদ্ধে শফিউল বশর, আমি ও ড্রাইভার ভোলানাথও গুলিবিদ্ধ হই। আমরা বাকিরা সরে যেতে পারলেও শফিউল বশর পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। ১৬ ডিসেম্বর তাকে জীবিত অবস্থায় আমরা উদ্ধার করেছিলাম।'
অক্টোবর মাসে পাকিস্তানি প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে প্রচার করতে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠায়। চট্টগ্রামে পর্যবেক্ষণ দল আগ্রাবাদ হোটেলে থাকায় হোটেল এলাকা কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তখন দেশের প্রকৃত অবস্থা জানান দিতে হোটেলে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে টানা তিন দিন রেকি করেন মুক্তিযোদ্ধারা। শেষ পর্যন্ত তারা হোটেলের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেন।
২৩ অক্টোবর রাতে মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে সাত-আটজন মুক্তিযোদ্ধা নিরাপত্তা প্রহরীদের জিম্মি করে ট্রান্সফরমারটি বিস্ফোরণ ঘটান। অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা শফিক মুন্সি বলেন, 'বাইরে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাহারায় রেখে প্রথমে নিরাপত্তা প্রহরী সেনা ও রাজাকারের বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে জিম্মি করি। ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরক বসাতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ ও গরিবউল্লাহ হাত পুড়িয়ে ফেলেন। বাকিদের সাহায্যে কাজ শেষ করে আমরা সরে যাই।'
ট্রান্সফরমারটি বিস্ফোরিত হলে এলাকা বিদ্যুৎহীন হওয়ার পাশাপাশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পর্যবেক্ষক দলের কাছে বার্তা পৌঁছে যায়।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে কৈবল্যধামে চট্টগ্রামের এককভাবে সবচেয়ে সফল অপারেশনটি চালিয়েছিলেন নগরের গেরিলারা। এই অপারেশনে নিহত হয়েছিল ২০ পাকিস্তানি সেনা।
গোপন সূত্রে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন, পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রেন বটতলী-কাট্টলী হয়ে মীরসরাই পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাম্পে সেনা ও রসদ পৌঁছে দিত। টানা তিন দিন রেকির পর কৈবল্যধামের ট্রেনে বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেন গেরিলারা। অপারেশনের দিন পার্শ্ববর্তী কর্নেলহাটে হাটের দিন হওয়ায় রইসুল হক বাহারের নেতৃত্বে পাশা, শফি, বেলা, বাদল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা হাটুরে ছদ্মবেশে বাজারের ব্যাগে করে বিস্ফোরক নিয়ে বের হন।
মুক্তিযোদ্ধা ইমতিয়ার উদ্দিন পাশা বলেন, 'পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার মধ্যেই বিস্ফোরক বসিয়ে আমরা লুকিয়ে পড়ি। প্রথমে দুটো বগি পার হলে বাহার ভাই টিঅ্যান্ডটি কর্ড (T&T cord) লাগানো তারে টান দেন। মুহূর্তেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ট্রেনের বগিগুলো কয়েক ফুট শূন্যে উঠে আছড়ে পড়ে। ট্রেনে থাকা সব পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।'
শহরের গেরিলা হামলা চালাতে ভারত থেকে কয়েকটি রুট দিয়ে চট্টগ্রামে অস্ত্র আনা হতো। এর মধ্যে মীরসরাই-বাঁশবাড়িয়া-কাট্টলী, ফটিকছড়ির খিরাম ও খাগড়াছড়ির রামগড় রুট ছিল অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধা শফিউল আলম বলেন, 'সীমান্ত থেকে মীরসরাই হয়ে অস্ত্র প্রথমে আসত বাঁশবাড়িয়ায়। সেখান থেকে সমুদ্রপথে কাট্টলী হয়ে অস্ত্র চট্টগ্রাম শহরে পাঠানো হতো।'
নানা ছদ্মবেশে সেসব অস্ত্র পরিবহন করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, 'এক মুক্তিযোদ্ধাকে লাশ বানিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করেও আমরা অস্ত্র এনেছিলাম।' অস্ত্র পরিবহনে বাদ যায়নি জাতিসংঘের গাড়িও। অস্ত্র আনা-নেওয়ার সময়ে একবার ধরা পড়েছিলেন সহযোগী জানে আলম। প্রবল নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তথ্য ফাঁস করেননি।
এদিকে যুদ্ধ চলমান রাখতে অস্ত্রের পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল রসদেরও। সেপ্টেম্বর মাসে রসদ কিনতে ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন পড়ে। এমতাবস্থায় নগরের গেরিলারা আগ্রাবাদের আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক লুটের সিদ্ধান্ত নেন। ইঞ্জিনিয়ার হারুনের নেতৃত্বে অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন এনামুল হক দানু, জাফর আজিজ, ফজলু, শফিউল বশর প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা।
নিরাপদে ফেরার জন্য গেরিলারা প্রথমে অস্ত্রের মুখে একটি গাড়ি ছিনতাই করেন। ইঞ্জিনিয়ার হারুন গাড়ি নিয়ে ব্যাংকের বাইরে অপেক্ষা করেন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রের মুখে ব্যাংকে ঢুকে উপস্থিত সবাইকে জিম্মি করলে মুক্তিযোদ্ধা ফজলু ও আজিজ ব্যাংকের ক্যাশ থেকে টাকা তুলে দ্রুততম সময়ে পালিয়ে যান।
অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক ভুঁইয়া বলেন, 'নগদ ১৯ হাজার টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ প্রায় ৪০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে যে ভল্ট ছিল, তা খেয়াল হয়নি। নয়তো আরও বেশি টাকা পাওয়া যেত। পরে ওই টাকা মৌলভী সৈয়দের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।'
যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম শহরের অন্তত ২০ জন গেরিলা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। নগরের ডালিম হোটেল, দেওয়ান হোটেল, গুডস হিল, সার্কিট হাউস, স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে তাঁদের ওপর চালানো হয়েছিল পৈশাচিক নির্যাতন।
২২ নভেম্বর রাতে অতর্কিত রেইডে মাদারবাড়ি থেকে ধরা পড়েন ৯৬-এফএফ গ্রুপ কমান্ডার জাহাঙ্গীর চৌধুরী। তিনি বলেন, 'মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আমাকে ডালিম হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা আর অস্ত্রের খবর ফাঁস করতে প্রতিদিন সকাল-বিকেল লোহার রড ও তার দিয়ে পেটানো হতো। ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত টানা ২৩ দিন তারা আমাকে অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। শত নির্যাতন সয়েও কোনো তথ্যই দিইনি।'
১ ডিসেম্বর ভোরে নগরের চান্দগাঁও থেকে ধরা পড়েন কেসি-৭ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান। তিনি বলেন, 'আমি ও আমার ছয় ভাইকে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ডালিম হোটেলে আনা হয়েছিল। চোখ খুলতেই দেখি সামনে মীর কাসেম আলী ও দৈনিক কর্ণফুলীর মালিক আফসার দাঁড়িয়ে। প্রথমেই ওরা অস্ত্র আর মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চাইল। "জানি না" বলতেই সিলিংয়ের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে শুরু হলো পেটানো। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি দিন যেন মৃত্যুপুরীতে কাটিয়েছিলাম।'
২৩ নভেম্বর রাতে নগরের মাছুয়া ঝর্ণা লেনে আলবদর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আবুল মনসুরকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল করিম বলেন, 'তিনি পাড়ায় পাড়ায় গেরিলাদের সংগঠিত করেছিলেন। তার অবদান কয়জনই-বা মনে রেখেছে?'
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের জন্য নিজেদের ঘরবাড়ি খুলে দিয়েছিলেন নগরের বাসিন্দারা। যুদ্ধের প্রথমদিকে ও আর নিজাম রোডের এনায়েত মাওলার কাকলী বাড়ি, পানওয়ালাপাড়া সবুজবাগ, হাজীপাড়ার মোনাফ সওদাগরের বাড়ি, ছোটপুলের নূর মোহাম্মদের বাড়ি ও পশ্চিম মাদারবাড়ীর কবির তোরণের বাড়ি গেরিলাদের আশ্রয়স্থল হলেও দিনে দিনে গেরিলাদের আশ্রয়স্থল শহরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম যেসব বাড়িতে গেরিলারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো হাজীপাড়ার জালাল কমিশনারের বাড়ি, মুহুরীপাড়ার ডা. আহাদের বাসা, পাঞ্জাবি লেনের আরশাদ আলীর বাড়ি, পাথরঘাটার হাজি শফি, আবু তালেব ও শামসুল আলমের বাসা, নালাপাড়ার দেওয়ান মাকসুদের বাড়ি, সদরঘাটের দৌলতুর রহমানের বাড়ি, মাদারবাড়ির মোজাফফর ও মিনতি দাশের বাড়ি, জয়পাহাড়ের ডা. মঈনুলের বাসা, শোলকবহরের নুরুল খানের বাড়ি, সরাইপাড়ার ফজর আলীর বাড়ি, কদম মোবারক এতিমখানা, হাফিজ মেম্বারের বাড়ি, দপ্তরীপাড়ায় মঞ্জুরুল, মাহবুবুব ও আমিরুল্লাহদের বাড়ি, জয়নগরের শান্তনু চক্রবর্তীর বাড়ি, হোটেল বলাকা, উত্তর কাট্টলীর জয়নাল আবেদীনের বাড়ি, আসকার দিঘিরপাড়ের আবদুল্লাহর বাড়ি, চকবাজারের কাপাসগোলার শফিক হায়দারের বাড়ি, সুরুচি হোটেল, আলকরণের মতিন টেইলার্স, আমানত শাহের মাজার প্রভৃতি।
নগরের আহত গেরিলাদের জন্য পাথরঘাটায় অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র খুলেছিলেন কুন্দ প্রভা সেন। বেগমজান স্কুলে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল খুলেছিলেন ডা. নুরুল আলম। আগ্রাবাদে চিকিৎসা দিতেন ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডা. আনোয়ার আলী ও মঞ্জুলা আনোয়ার।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরবাসীর অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'চট্টগ্রাম শহর তখন অবাঙালি ও বিহারি অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতেও শহরের মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাবার জুগিয়েছে। জনগণই মূলত যুদ্ধ করেছে, আর আমরা তাদের সহযোগিতা করেছি।'