ভেনেজুয়েলা-কলম্বিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার নেপথ্যে কী
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি, তেলভিত্তিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, মাদকবিরোধী অভিযান এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিযোগ—সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলাকে কেন্দ্র করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলাকে বলছে 'নারকো–টেররিস্ট স্টেট' বা মাদককারবারি রাষ্ট্র। সেইসঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সামরিক বাহিনীকে শীর্ষ মাদককারবারি হিসেবেও চিহ্নিত করেছে।
সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগকে অপরাধ মোকাবিলার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে রাজনৈতিক চাপের মতো। দ্য টাইমস জানিয়েছিল, কলম্বিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মাদকবিরোধী সহযোগিতাও এখন টানাপড়েনে। তাই এই ঘটনা পুরো অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য পাল্টে দিচ্ছে।
ক্যারিবিয়ানে সামরিক তৎপরতা: অভিযান নাকি চাপের পূর্বাভাস
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ওয়াশিংটন দাবি করছে, তাদের 'অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার' মাদকবিরোধী অভিযান।
ভক্স জানিয়েছে, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযানে ২০টির বেশি নৌযান ধ্বংস করেছে এবং এতে নিহত হয়েছে ৮০ জনেরও বেশি।
কিন্তু সামরিক প্রস্তুতির পরিসর নিয়ে উঠেছে নতুন প্রশ্ন। এনবিসি নিউজের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে হাজারো সেনা, উন্নত ড্রোন, যুদ্ধবিমান ও বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেছে ক্যারিবিয় অঞ্চলে।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডকেও সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। এফ-৩৫ সহ অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র সেখানে আছে। বিশেষ অপারেশন হেলিকপ্টার ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর ক্যারিবিয়ানে এত বিশাল মহড়া আর দেখা যায়নি। ফলে এটি সম্ভাব্য সংঘাতের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তেল ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কলম্বিয়ার অভিযোগ
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই সাবেক গেরিলা যোদ্ধা ও কলম্বিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোর সঙ্গে তুমুল বিরোধে জড়িয়েছে। এরই মধ্যে পেত্রো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ব্যাখ্যাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন।
সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভেনেজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মূল কারণ দেশের বিপুল তেলসম্পদ।
তার ভাষায়, ভেনেজুয়েলার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুদ রয়েছে। আর এটিই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাদক সংক্রান্ত অভিযোগকে খারিজ করে বলেন, ভেনেজুয়েলা বড় কোনো মাদক উৎপাদক দেশ নয়। আর মাদুরোর মাদক–যোগসূত্র সম্পর্কেও কোনো প্রমাণ পাননি তারা।
পেত্রোর মতে, মাদুরোর মূল সংকট 'গণতন্ত্রের অভাব'। আর এই অভাবকেই যুক্তরাষ্ট্র পুঁজি করতে চাইছে তেলের জন্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকেও সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করেন।
মাদকবিরোধী অভিযান ও সরকার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক চোরাচালান ঠেকানো ও অপরাধী সরকারকে চাপে রাখা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার অংশ।
গত ১২ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভেনেজুয়েলার কোনো সরকার নেই। সেখানে একটি অবৈধ শাসনব্যবস্থা রয়েছে। আর সেই ব্যবস্থাও মাদকচক্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত—যা মাদুরোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া, জি–৭ এ উপস্থিত অনেক দেশই মাদুরো সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র আজ সিএনএনকে জানান, ট্রাম্প প্রশাসন ক্যারিবিয়ানে মাদকবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে মাদুরো সরকারের 'কুপ্রভাব' থেকে আমেরিকানদের রক্ষা করতে।
সম্প্রতি ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। একই সময়ে ট্রাম্প এটাও জানিয়েছেন, তিনি মাদুরোর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তবে কী কথা বলেছেন, তা খোলাসা করেননি।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের আরও বলেছিলেন, 'আমরা যদি সহজে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি, সেটাই করা ভালো। যদি সহজে তা না পারি, তাও ভালো।'
কলম্বিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি
এরই মধ্যে গত অক্টোবরে মার্কিন অর্থমন্ত্রী বেসেন্ট কলম্বিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার দেন। এরপর তিনি সিবিএস নিউজকে পেত্রোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, 'মাদক চোরাকারবারি চক্রকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে দিয়েছেন।'
ট্রাম্প অবশ্য কলম্বিয়ার মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার জন্য সরাসরি সে দেশের নেতৃত্বকেই দায়ী করেন।
সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনা: সম্ভাব্য সংঘাতের পথ
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক বিকল্প নিয়ে ভক্সের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রাক্তন মেরিন কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ান। তার মতে, স্থল আক্রমণ প্রায় অসম্ভব।
রাশিয়া ভেনেজুয়েলাকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু এর বাইরে থেকেও বিমান অভিযান চালানো সম্ভব।
ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভ্লাদিমির প্যাদ্রিনো লোপেজ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দ্রুতই। তিনি আকাশসীমা রক্ষায় সামরিক বাহিনী, বেসামরিক যোদ্ধাগোষ্ঠী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সংগঠকদের নিয়ে বড় মহড়ার ঘোষণা দেন।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়াকে ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্বের ওপর 'সরাসরি হুমকি' হিসেবেই বর্ণনা করেন।
সব মিলিয়ে তেল বাণিজ্য, ভূরাজনীতি, মাদকবিরোধী অভিযানে সামরিক প্রস্তুতি—এগুলো ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভব্য সংঘাতের আশঙ্কা জোরদার করছে।