ট্রাম্প কেন ভেনেজুয়েলায় মজেছেন?

মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
4 November 2025, 02:09 AM
UPDATED 4 November 2025, 11:15 AM

কথিত আছে—আমেরিকা যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন নেই। এই কথা কেউ সরাসরি বলেননি। তবে 'আমেরিকার বন্ধুত্ব' বা বন্ধুত্ব না থাকার মূল্য অনেক দেশকেই চুকাতে হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ ভেনেজুয়েলা। সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, দেশটির নেতা নিকোলাস মাদুরোকে না হটানো পর্যন্ত থামবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তবে অনেকের মতে, ঘটনার পেছনের ঘটনা হচ্ছে ভেনেজুয়েলার প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভারের দিকে নজর পড়েছে এই বিশাল ক্ষমতাধর রিপাবলিকান নেতার। মধ্যপ্রাচ্যের সেরা তেলের উৎসগুলো মার্কিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ভেনেজুয়েলাকেই রেসের ঘোড়া হিসেবে দেখছেন ট্রাম্প।

তার এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে 'প্রাচীনপন্থি' মাদুরোকে সরিয়ে নোবেলজয়ী বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান ট্রাম্প—এমন তত্ত্ব এখন আর শুধু কানাঘুষার পর্যায়ে নেই।

আমেরিকার শত্রু হলে বিপদ, বন্ধু হলে মরণ!

পূর্ব ইতিহাস বলছে—মার্কিন আশীর্বাদ পেয়ে বিশ্বের অনেক নেতা তার দেশের শীর্ষ পদে বসেছেন। এমন অনেকে এই পদে গেছেন, যারা কস্মিনকালেও ভাবেননি রাজনীতিতে আসবেন।

তা সত্ত্বেও, পরবর্তীতে দেখা গেছে তাদের অনেকেই দেশকে 'ডুবিয়ে' দিয়েছেন। অনেকে আবার মার্কিনিদের বিরাগভাজন হয়ে পৈত্রিক প্রাণটিও খুইয়েছেন।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে 'অনাস্থা', দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তথাকথিত 'ডিপ স্টেটের' দৌরাত্ম্য, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি, লিবিয়ায় পাইপের ভেতর গুলি খেয়ে গাদ্দাফির মর্মান্তিক মৃত্যু আর সাম্প্রতিককালে ভেনেজুয়েলায় মাদুরোকে মাদক সম্রাট আখ্যা দেওয়া—সব কিছুতেই আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকা না থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।

প্রয়াত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্ব নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক সুরে 'আমেরিকার শত্রু হলে বিপদ, বন্ধু হলে মরণ!'—এ কথা বলেছিলেন। তার এই মন্তব্যের একটি প্রেক্ষাপট আছে।

Ganobhaban-1-1.jpg
২০২৩ সালে ১০০ বছর বয়সী হেনরি কিসিঞ্জার চীনের নেতা শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ছবি: রয়টার্স

মার্কিনিদের সমর্থন পেয়ে ভিয়েতনামের ক্ষমতা নেন প্রেসিডেন্ট নো দিন জিয়েম। কিন্তু পরবর্তীতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর যোগসাজশে ১৯৬৩ সালে তাকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করা হয়। এতে মূল ভূমিকা রাখেন আমেরিকার পছন্দের সামরিক কর্মকর্তা নোইয়ান ভান থো।

এরপর ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ভান থোকে উৎখাতের উদ্যোগে আমেরিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানান কিসিঞ্জার।

'(এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে) বিশ্বের বাকি দেশগুলো যে বার্তা পাবে, তা হলো, আমেরিকার শত্রু হওয়া একটি বিপজ্জনক ব্যাপার, কিন্তু আমেরিকার বন্ধুত্ব অর্জন করলে মরণ নিশ্চিত,' বলেন কিসিঞ্জার।

যেভাবে আমেরিকার 'লেজে' পা দিলেন মাদুরো

ভেনেজুয়েলার ইস্পাত কঠিন শাসক উগো চাবেসের (হুগো শাভেজ) অনুসারী নিকোলাস মাদুরোকেও পছন্দ করেন না ট্রাম্প। বিষয়টি নিয়ে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। তবে তাদের এই আদর্শিক দ্বন্দ্ব নতুন নয়।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১) মাদুরোর সমাজতান্ত্রিক প্রশাসনকে 'নিরাপত্তা হুমকি' হিসেবে বিবেচনা করতো ওয়াশিংটন। তাদের সন্দেহ ছিল, মাদুরোর সরকার সরাসরি দেশটির মাদকচক্রের সঙ্গে জড়িত। ভেনেজুয়েলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের অভিযোগও আনে তারা।

পাশাপাশি, অবৈধ অভিবাসী, যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক—এসব বিষয়ও ট্রাম্পের মাদুরো-এলার্জির বড় কারণ।

২০২০ সালে মাদুরো ও তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে মাদকপাচারে জড়িত থাকার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। শুরুতে মাদুরোকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন। বিরোধীনেতা হুয়ান গুয়াইদো-এর প্রতি সমর্থন জানান ট্রাম্প। সঙ্গে দেশটির ওপর বড় আকারে আর্থিক বিধিনিষেধও আরোপ করেন তিনি।

এসব উদ্যোগে তেলসমৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মাদুরোকে উৎখাতের একের পর এক উদ্যোগ বানচাল হয়। অভিযোগ আছে, এসব উদ্যোগে ইন্ধন জুগিয়েছে সিআইএ।

পরবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় আসলে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়। জো বাইডেনের আমলে ভেনেজুয়েলার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ আংশিকভাবে তুলে নেওয়া হয়। সামান্য হলেও তেল রপ্তানির অনুমতি পায় দেশটি।

গত জানুয়ারিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ফেরেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে এসেই নতুন করে মাদুরোর বিরুদ্ধে যেন 'ধর্মযুদ্ধে' নেমে পড়েন তিনি। মূলত ২০২৪ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচন ও সেখানে মাদুরোর বিজয়কে নিয়েই প্রশ্ন তোলেন ট্রাম্প ও তার মিত্ররা। সবার অভিযোগ—সেটা ছিল পাতানো ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন।

এবার তারা শান্তিতে সদ্য-নোবেলজয়ী ও স্বেচ্ছা নির্বাসিত বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো'র প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

machado.jpg
ছবি: রয়টার্স

প্রথম মেয়াদ থেকেই ট্রাম্প দাবি করে আসছেন, ভেনেজুয়েলা থেকে পাচার হয়ে আসা মাদক মার্কিনিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'বছরের পর বছর ভেনেজুয়েলা থেকে আসা কোকেইনের বন্যায় ভেসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা আমাদের সমাজকে কলুষিত করছে। এর মাধ্যমে নেশার ভয়ঙ্কর মহামারি বেগবান হয়েছে আর সব মার্কিনিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে।'

চলতি বছরের জুলাইয়ে স্কটল্যান্ডের এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, 'এখনো ভেনেজুয়েলা আমাদের দেশে মাদক পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। তারা খুব নোংরা কাজ করে যাচ্ছে। আমরা তাদেরকে এটা চালিয়ে যেতে দিতে পারি না।'

ট্রাম্পের মাদুরো-এলার্জি

দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকে মাদুরোর প্রতি যে আচরণ করছেন ট্রাম্প, তাকে 'এলার্জি' বললেও কম বলা হবে।

সর্বশেষ গত রোববার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য মার্কিন হামলার বিষয়ে মিশ্র বার্তা দিয়েছেন।

লাতিন আমেরিকার দেশটির বিরুদ্ধে 'যুদ্ধে' যাবে না যুক্তরাষ্ট্র—এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন সাবেক আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। তবে একইসঙ্গে এটাও যোগ করতে ভুলেননি; 'মাদুরোর দিন ঘনিয়ে এসেছে'।

সিবিএসের সিক্সটি মিনিটস শিরোনামের অনুষ্ঠানে দেওয়া ট্রাম্পের সাক্ষাৎকারটি গত রোববার প্রচারিত হয়েছে।

60 Minutes Trump
সিবিএসের সিক্সটি মিনিটস অনুষ্ঠানে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত স্ক্রিণশট

ইতোমধ্যে 'মাদক পাচারে ব্যবহার হচ্ছে' সন্দেহে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছেন ট্রাম্প। এতে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাচ্ছে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন 'আমার সন্দেহ আছে। আমার মনে হয় না এরকম কিছু হবে।'

তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাদুরোর দিন ঘনিয়ে এসেছে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'হ্যাঁ, আমি এই প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবই দেব। আমার ধারণা ব্যাপারটা এরকমই।'

মাদুরো নয়, তেল চান ট্রাম্প?

যুক্তরাষ্ট্রে মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক পাচারের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আছে। তিনি ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা মাদক পাচারকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে কারাকাসে সরকার পরিবর্তন করতে চায়। এর মূলে আছে ভেনেজুয়েলার তেল কুক্ষিগত করার বাসনা।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশাল নৌবহর ও বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

গত আগস্ট থেকে ক্যারিবীয় অঞ্চলের দক্ষিণে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি পুয়ের্তোরিকোসহ কয়েকটি জায়গায় সেনা ও নৌযান মোতায়েন করেন ট্রাম্প। এই মাদকবিরোধী অভিযানের দায়িত্ব নেয় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড (সাউথকম)।

USS Gerald Ford
বিশ্বের সবচেয়ে বড় রণতরী ইউএসএস জেরার্ল্ড ফোর্ড । ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ১০টি নৌযান ও প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে ওয়াশিংটন। আগামী সপ্তাহে রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড এসে পৌঁছালে নৌযানের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪টি। সেনার সংখ্যাও আরও চার হাজার বাড়বে।

সেনা ও জাহাজের পাশাপাশি অসংখ্য যুদ্ধবিমানও মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এখন পর্যন্ত ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন নৌযানের ওপর ১৫ বারেরও বেশি হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব ঘটনায় অন্তত ৬৫ জন নিহত হয়েছেন। গত শনিবারও হামলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদক পাচারকারীদের ওপর হামলা চালালেও সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এসব হামলাকে 'বিচারবহির্ভূত' হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

এখনো ওয়াশিংটন এমন কোনো প্রমাণ প্রকাশ্যে আনেনি, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে হামলার ক্ষতিগ্রস্ত নৌযানগুলো আদতে মাদকপাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তারা কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ হুমকি ছিল।

rig.jpg
ভেনেজুয়েলার একটি তেলের খনি। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সব মিলিয়ে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে তথা ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই তর্জন-গর্জনের আসল উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত জল্পনাকল্পনা চলছে। মাদকপাচার বন্ধের জন্য এ ধরনের রণসজ্জা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের প্রাধান্যের কাজ হওয়া উচিৎ নিজ দেশে মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করা। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সবচেয়ে বিপজ্জনক মাদক ফেন্টানিল ভেনেজুয়েলায় তৈরি হয় না।

ফলে, মাদক বা মাদুরো দমন নয়—তেল খনি নিয়ন্ত্রণে নেওয়াই ট্রাম্পের উদ্দেশ্য—এই ধারণা হালে পানি পাচ্ছে।